International Mother Language Day

৮৪! তবু একুশ-প্রাঙ্গণে এ-পার বাংলার সন্ধ্যারানি

শহিদ মিনারের সামনে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে নিশীথরঞ্জন দাস। দু’চোখ বন্ধ। আনন্দাশ্রু দু’গাল বেয়ে নামছে অঝোর ধারায়।

Advertisement

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

ঢাকা শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:১৫
Share:

একুশের সকাল: ঢাকার ভাষা শহিদ স্মারকের সামনে। শুক্রবার। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী

কাল মধ্যরাতে মানুষের যে ঢল শুরু হয়েছিল, শুক্রবার দুপুরেও তা এগিয়ে চলেছে। হাতে ফুল, পরনে কালো চিহ্নের পোশাক, খালি পায়ে মানুষের কাতার। সেই ঢেউয়ে ভেসে এগিয়ে চলেছে একটা হুইল চেয়ার। চুরাশি বছরের মা সন্ধ্যারানিকে তাতে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে চলেছেন বরুণ নাগ। একুশের শহিদ মিনারে একবার শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের নিউ ব্যারাকপুর থেকে। বরুণবাবু বললেন, ‘‘মায়ের বহু দিনের ইচ্ছে!’’ তা পূরণ করতেই পাসপোর্ট-ভিসা করে এই প্রথম তিনি ঢাকায় হাজির। বৃদ্ধার চোখেমুখে কী যে খুশির ঝিলিক!

Advertisement

শহিদ মিনারের সামনে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে নিশীথরঞ্জন দাস। দু’চোখ বন্ধ। আনন্দাশ্রু দু’গাল বেয়ে নামছে অঝোর ধারায়। অসমের করিমগঞ্জ থেকে তাঁরও এই প্রথম বার ঢাকায় আসা। মাইকে তখন ঘোষণা হচ্ছে, ‘অসমের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের নেতা নিশীথবাবুকে পেয়ে আমরা গর্বিত।’ ৮৯ বছরেও একুশের শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানাতে শক্ত পায়ে হেঁটে এসেছেন অনেকটা পথ। পাশের মঞ্চ থেকে নেমে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং অধ্যাপকেরা। হাত ধরে তাঁকে নিয়ে গিয়ে বসালেন মঞ্চে। দীর্ঘ আলাপে শুনলেন বরাকে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে মানুষের আমরণ লড়াইয়ের কথা।

মার্চে শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্রদূত শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। ব্রিটিশের দ্বিজাতি তত্ত্বের কৌশলে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণটি হয় এই ভাষা আন্দোলনে। এ বার তাই একুশের বাড়তি অনুষঙ্গ ‘মুজিববর্ষ’, আগামী মাস থেকে ৩৬৫টি দিন যা পালন করবে বাংলাদেশ সরকার।

Advertisement

ছেলে বরুণ নাগের সঙ্গে সন্ধ্যারানি। নিজস্ব চিত্র

বুধবার রাতে ঘড়ির ঘণ্টা ও মিনিটের কাঁটা এক হতেই বেজে উঠল ব্যান্ড। কালো চাদর গায়ে এগিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশে কালো মুজিবকোটে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ। শ্রদ্ধার ফুল বেদিতে রেখে তাঁরা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই অন্য মন্ত্রী ও নানা দেশের কূটনীতিকদের পালা। তার পরে খুলে গেল আগল। জনস্রোতে রাত ফুরোল, সূর্য উঠল সকালের। জনসাগরে ঢেউয়ের উথাল-পাতাল শুক্রবার সন্ধ্যাতেও। স্লোগান উঠছে, ‘জয় বাংলা’, ‘ভাষা শহিদেরা ঘুমোও, আমরা জেগে আছি’। ব্যানার আর ফুলের স্তবক নিয়ে নানা সংগঠন। ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা’ নামে একটি সংগঠনের প্রতিজ্ঞা, ‘অসাম্প্রদায়িক মৌলবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়বই’। আবার ফুল হাতে আর একটি সংগঠনের ফেস্টুনে বার্তা, ‘ভালবাসা সর্বত্র ছড়িয়ে দাও’।

ছোট্ট নদী এসেছে সাদাকালো শাড়ি পরে। গম্ভীর মুখে ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে। তার গালে তখন তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠছে শহিদ মিনারের প্রতিরূপ। পাশে বাবার হাতে রঙিন ফুলের মুকুট, একটু পরে যা মাথায় পরে নেবে নদী।

বৃহস্পতিবার রাতভর জেগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। এখানে-ওখানে ছোট ছোট জটলা থেকে ভেসে আসছে গিটারের সুর, সঙ্গে সমবেত কণ্ঠ ছেড়ে বাংলা গান। কোথাও বা রবীন্দ্রনাথ— ‘আমার সোনার বাংলা’। আমের মুকুলের গন্ধে ম-ম বাতাসে অল্প শিরশিরানি যখন ঠাওর হওয়া শুরু হল, আলো উদ্ভাসিত হল পুবের দিগন্তে।

সেই অনাবিল ভোরে ফুলে ফুলে ঢাকা শহিদ মিনারকে মুখোমুখি রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে দীপ্সিতা ধর। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াকু ছাত্রনেত্রী। নতুন লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা, সে-ও তো আরও এক মৌলবাদের বিরুদ্ধেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement