গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
নতুন বছরের শুরুতেই আশঙ্কাটা স্পষ্ট ছিল ‘নেচার’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছিল, জলবায়ু বিজ্ঞানীরা শীঘ্রই হয়তো জানিয়ে দেবেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা ২০২৪ সালে যতটা বেড়েছে, ততটা আগে কখনও বাড়েনি। তার দিন কয়েকের মধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে শুরু করে আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-র মতো সংস্থা ঘোষণা করল, আশঙ্কা নির্ভুল।
নাসার প্রশাসক বিল নেলসন বলছেন, ‘‘১৮৮০ সাল থেকে তাপমাত্রার খতিয়ান রাখা শুরু হয়েছিল। সেই ইস্তক ২০২৪ সালই উষ্ণতম।’’ ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি করার সময়ে রাষ্ট্রনেতারা অঙ্গীকার করেছিলেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্প বিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের আবহাওয়া সংস্থা ডব্লিউএমও জানিয়েছে, ওই ঊর্ধ্বসীমাকে ছাপিয়ে ২০২৪ সালে ১.৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা। এই বিপদসঙ্কেত ২০২৩ সালেই ধরা পড়েছিল, যে বছর পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় ছিল শিল্প বিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ১.৪৫ ডিগ্রি বেশি। প্রশ্ন হল, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি কি নিছকই ব্যতিক্রম, না বছর-বছর তা ধারাবাহিক ভাবে বেড়েই চলবে? গবেষকদের পূর্বাভাসের চেয়েও কি দ্রুত হারে গরম হচ্ছে ভূ-পৃষ্ঠ? এই সব প্রশ্নই এখন ভাবাচ্ছে।
গত মাসে ওয়াশিটন ডিসি-তে আমেরিকান জিয়োফিজ়িক্যাল ইউনিয়ন (এজিইউ)-এর সম্মেলনেও আলোচনার কেন্দ্রে ছিল উষ্ণায়নের এই লাগামছাড়া বৃদ্ধি। বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, এর একটি সম্ভাব্য কারণ ২০২৩ সালের মাঝামাঝি শুরু হওয়া এল-নিনো তথা পূর্ব নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ছুটে আসা গরম সমুদ্রস্রোতের প্রভাব। আরও একটি কারণ হতে পারে ধূলিকণার ঘাটতি। গত কয়েক বছরে বিশ্ব জুড়ে বায়ুদূষণে যেটুকু লাগাম পরানো গিয়েছে, তাতে ধূলিকণা কমেছে। এই কণা এক দিকে সূর্যালোক, তথা সূর্যের তাপকে মহাকাশে পাল্টা প্রতিফলিত করে দেয়, আবার অন্য দিকে নিচু স্তরের মেঘকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এই নিচু মেঘের চাদরও কম্বলের মতো ভূ-পৃষ্ঠকে ঘিরে রেখে সূর্যের তাপ আটকায়। ‘নেচার’-এর প্রবন্ধটি বলছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘আইএমও’ আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকা জাহাজের ধোঁয়া থেকে নির্গত গন্ধকের পরিমাণ ৮০ শতাংশ কমানোর নিয়ম বেঁধে দেওয়ার পরে দেখা গিয়েছে, এর ফলেও বাতাসে ভাসমান কণার পরিমাণ কমেছে। ফলে কমেছে মেঘও। এজিইউ-এর বৈঠকের আগে ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত একগবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, এল-নিনোর প্রভাবের পাশাপাশি নিরক্ষীয় অঞ্চল ও উত্তর গোলার্ধের বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে নিচু স্তরের মেঘের চাদর কমে যাওয়ার ফলেই ২০২৩ সালে মাত্রাছাড়া ভাবে বেড়েছিল পৃথিবীর তাপমাত্রা।
কিন্তু এই সব যুক্তি যে অভ্রান্ত, এমন চূড়ান্ত রায় দিতে পারছেন না কোনও গবেষকই। ‘সায়েন্স’ পত্রিকার গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক, তথা জার্মানির আলফ্রেড ওয়েগেনার ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী হেলগে গোয়েসলিং বলেই দিচ্ছেন, ‘‘পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে চলার এগুলোই যে অকাট্য প্রমাণ, এমন কথা খুব সাবধানে বলতে হবে। তবে কিছু একটা তো ঘটছেই।’’ বিজ্ঞানীদের সন্দেহ, শুধু দূষণ কমা নয়, সরাসরি উষ্ণায়নের প্রভাবেও নিচু স্তরে মেঘ কমছে।বৃষ্টি নামানো, সূর্যের তাপ আটকানো এই নিচু মেঘ ভূ-পৃষ্ঠের মাত্রাছাড়া গরমের চোটে উঠে যাচ্ছে আরও উপরে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এই ঘটনাটিই একটি আবর্তের (ফিডব্যাক লুপ) চেহারা নিচ্ছে। অর্থাৎ, উষ্ণায়ন বাড়লে মেঘ কমবে, মেঘ কমলে উষ্ণায়ন বাড়বে— এমন চলতে থাকলে আগামী দশকগুলির কপালে দুঃখ আছে।
বিজ্ঞানীদের চিন্তার আরও একটা বড় কারণ হল, তাঁদের পূর্বাভাস না মেলা। যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি গরম ছিল ২০২৩ সালে। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন,এল-নিনোর জন্য ২০২৪-এর গোড়ার দিকটায় গরম থাকবে। পরের দিকে তাপমাত্রা স্বাভাবিকে নেমে আসবে নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ক্যালিফর্নিয়ার বিজ্ঞানী জ়িক হাউসফাদার বলছেন, ‘‘২০২৪-এর গরমকে আমরাই তেমন আমল দিইনি।’’
ফলে প্রশ্ন মূলত একটাই। তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বগতি কি বজায় থাকবে ভবিষ্যতেও? উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া যে আশঙ্কা প্রবল বাড়িয়ে তোলে, সেই দাবানলের তাণ্ডবে নতুন বছরের গোড়াতেই ছারখার আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের একাংশ। অনেকে বলছেন, মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকা উষ্ণায়ন কমানোর নানাবিধ পদক্ষেপ ও তার পরে অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া আপাতত আর কোনও পথ নেই।