বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে দ্রুত পাল্টাচ্ছে আলাস্কার জলবায়ু। আজ প্রথম পর্ব

না-খেয়ে মরছে তিমি, হৃদ্‌রোগে স্যামন 

আর হবে না-ই বা কেন! আমাদের শহরের উত্তর ও দক্ষিণে ঘন বনাঞ্চল। দু’জায়গাতেই দাবানলের প্রবল প্রকোপ চলছে। এখানে জুন-জুলাই মাসে দাবানল নতুন কিছু নয়।

Advertisement

এলিজ়াবেথ বেলা অ্যাঙ্করেজ (আলাস্কা)

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৯ ০৫:১৫
Share:

আলাস্কার সমুদ্রসৈকতে ভেসে এসেছে স্যামনের দেহ। এপি

বাইরে বেরোলেই চোখ জ্বালা। তার সঙ্গে নিঃশ্বাসের কষ্ট। সপ্তাহভর এ রকমই কাটছে আমাদের। মানে, আমরা যারা আলাস্কার রাজধানী অ্যাঙ্করেজে থাকি, তাদের।

Advertisement

আর হবে না-ই বা কেন! আমাদের শহরের উত্তর ও দক্ষিণে ঘন বনাঞ্চল। দু’জায়গাতেই দাবানলের প্রবল প্রকোপ চলছে। এখানে জুন-জুলাই মাসে দাবানল নতুন কিছু নয়। কিন্তু এ বছর এই ‘দাবানল মরসুম’ চলছে নির্ধারিত সময়ের অনেক পর পর্যন্ত। এখনও আকাশ সব সময়ে ধোঁয়ায় ঢাকা, সূর্য টকটকে লাল। এই গ্রীষ্মে সাধারণ আলাস্কাবাসীও টের পেয়ে গেলেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তন দৈনন্দিন জীবনে কী ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। বুঝে গেলেন, কোন কঠোর বাস্তবের সঙ্গে লড়াই চালাতে হবে। না হলে আরও বিপদ!

আলাস্কার মানুষ গরমকালে অনেকটা সময় বাড়ির বাইরে কাটাতে পছন্দ করেন। ঝকঝকে আকাশ, বরফগলা পাহাড়, সমুদ্র, নদী— সব মিলিয়ে আলাস্কার প্রকৃতি এ সময়ে বড়ই মনোরম। পাহাড়ে হাইকিং, নদীতে মাছ ধরা, সাইকেল চালিয়ে মাইলের পর মাইল পাড়ি দেওয়া— বছরের এই সময়ে এ সবেই মেতে উঠি আমরা। প্রচুর পর্যটকও আসেন।

Advertisement

অনেক আলাস্কাবাসীর মতোই আমার এখানে জন্ম নয়। কর্মসূত্রে দু’দশক আগে এখানে এসেছিলাম। এবং থেকে গিয়েছিলাম। কুড়ি বছর ধরে এখানে ধীরে ধীরে জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। সমুদ্র ও নদীর পাড়ের ভাঙনের জন্য গ্রামের পর গ্রাম জলের তলায় চলে গিয়েছে। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। বাজ পড়ে জঙ্গলে আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। পাহাড়ের গায়ে— যেখানে আগে শুধুই উঁচু উঁচু গাছ দেখা যেত— এখন সেখানে ছোট ছোট ঝোপঝাড়ও গজাতে শুরু করেছে। সবুজ বেড়ে গিয়েছে তুন্দ্রা অঞ্চলেও।

অ্যাঙ্করেজ শহরের অদূরেই দাবানল।রয়টার্স

এই সব পরিবর্তন তো অনেক দিন ধরেই চলছে। কিন্তু এ বছর প্রকৃতির যে খামখেয়ালিপনা, তা বেশ চোখে পড়ার মতো। শুধু পরিবেশবিদদেরই নয়, সবাইকে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার পক্ষে এই পরিবর্তনগুলো যথেষ্ট। জুলাইয়ে তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফ্যারেনহাইট (৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ছাড়াতেই প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্ময়সূচক পোস্টের ঝড় বয়ে গেল। তার পরে লোকজন দোকানে ছুটল পাখা আর বরফ কিনতে। আমাদের বাড়িগুলো এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যাতে তারা গরমটা ধরে রাখতে পারে। তাপমাত্রা এতটা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ির ভিতরটা উনুনের মতো গরম হয়ে যাচ্ছিল।

আলাস্কায় জলবায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এই সব প্রাকৃতিক দাবানল। ‘ব্ল্যাক স্প্রুস’-এর মতো কিছু গাছের প্রজননের জন্যও এই দাবানল খুব জরুরি। কিন্তু এ বছর যেটা অস্বাভাবিক তা হল— দাবানলের প্রকোপ শুরু হল অনেক আগে থেকে এবং তা চলছেও অনেক দিন ধরে। দাবানলের প্রকোপে মাঝেমধ্যেই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে কোনও না কোনও হাইওয়ে। বাধা পড়েছে গরমকালের অবসর যাপনের চেনা ছন্দে। ক্যাম্পিং, পিকনিক, মাছ ধরা, গাছ থেকে ব্লু বেরি তোলা, কোনও কিছুই প্রাণ ভরে করার সুযোগ পাচ্ছি না আমরা। বিপুল ক্ষতি হচ্ছে এখানকার পর্যটনশিল্পেরও।

শুধু কি মানুষ! অনেক বেশি ক্ষতি হচ্ছে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের। লক্ষ লক্ষ স্যামন মাছ মারা গিয়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে যাওয়ার ফলেই এই প্রজাতির মাছ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সমুদ্রসৈকতে ভেসে এসেছে অসংখ্য গ্রে হোয়েল প্রজাতির তিমির দেহ। প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রের জল গরম হয়ে যাওয়ায় ঠিক মতো খাবার জোটেনি এই সব তিমির। না খেতে পেয়েই মারা যাচ্ছে তারা। গরমে বেড়ে গিয়েছে এক ধরনের গাছের পোকা। তাদের প্রাদুর্ভাবে মরে যাচ্ছে বড় বড় স্প্রুস গাছ। মাইলের পর মাইল ব্লু বেরি লতা শুকিয়ে গিয়েছে। মাটি শুকিয়ে ধুলোর প্রকোপ অনেক বেড়ে গিয়েছে। আর চোখে জ্বালা ধরানো দাবানলের ধোঁয়া তো আছেই। বাড়ির ভিতর দমবন্ধ করে দেওয়া গরম, বাইরে দূষিত হাওয়া— প্রতিকূল পরিবেশের এই সাঁড়াশি চাপের জন্য আলাস্কাবাসী সত্যিই প্রস্তুত ছিল না।

এ বার যে প্রকৃতি অন্য রকম খেল্ দেখাবে, তা অবশ্য বেশ কিছু দিন আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম। আমার বাগানের গাছগুলোয় অন্যান্য বছরের থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগেই ফুল ধরল। অন্য দিকে, বাগানের মটরশুঁটি লতায়, যাতে প্রতি বছর প্রচুর ফলন হয়, এ বছর শুকিয়ে নুয়ে পড়ল। অসময়ে গাছে গাছে ফুল ধরায় বিপদে পড়েছে এখানকার সব থেকে জনপ্রিয় ফুল ‘পিয়োনি’র ব্যবসা। বিয়ের মরসুমে এই ফুলের জন্য প্রচুর বরাত পান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এ বছর আগেভাগে ফুল ফুটে যাওয়ায় তাঁদের মাথায় হাত— কয়েক মাস ধরে ফুল কী ভাবে তাজা রাখবেন তাঁরা!

হাওয়া অফিস জানিয়েছে, আরও বেশ কয়েক মাস এই রকম শুষ্ক, গরম আবহাওয়া থাকবে এখানে। তার পরে নিশ্চই ঠান্ডা পড়বে। আবার বরফে ঢেকে যাবে আমাদের এই প্রায়-মেরু অঞ্চল। কিন্তু তার পরে? কী হবে সামনের বছর? আরও কত ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করে রয়েছে আমাদের জন্য? সারা পৃথিবীর জন্য?

উত্তরটা জানা গেল না। শুধু হাড়-হিম করা আতঙ্কটা রয়ে গেল।

লেখক পরিবেশবিদ

অনুলিখন: সীমন্তিনী গুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement