উৎসবের আমেজটা আগে থেকেই ছিল ডেমোক্র্যাট শিবিরে। তবে তা সত্ত্বেও চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের মধ্যেও আনন্দের জোয়ারে গা ভাসাননি বহু সমর্থক। তবে আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট পদে জো বাইডেনের নির্বাচনের খবরটা সরকারি ভাবে ঘোষিত হওয়ামাত্রই সেই বাঁধ ভেঙেছে। বাইডেন-হ্যারিস জুটির জয়ে উল্লাস মেতে উঠেছেন তাঁরা। দেখে নিন তারই কিছু টুকরো অংশ।
জো বাইডেন-কমলা হ্যারিস জুটির সাফল্যে স্বাভাবিক ভাবেই আত্মহারা হয়েছেন সমর্থকেরাও। সরকারি ভাবে ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট পকেটস্থ করার আগে থেকেই আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে জয়ের আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছিলেন বাইডেন-সমর্থকেরা। পেনসিলভেনিয়ায় সরকারি ভাবে জয় ঘোষণার আগেই রাস্তায় নেমেছেন অনেকে। জয়ের পরও দেখা গিয়েছে ওই রাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় পোস্টার হাতে নেমে পড়েছেন সেখানকার নানা সম্প্রদায়ের বাসিন্দা।
প্রেসি়ডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতীয় সময় রবিবার সকালে প্রথম ভাষণ দিয়েছেন বাইডেন। ডেলাওয়্যারে নিজের শহর উইলমিংটনের মঞ্চে ছিলেন তাঁর জয়ের অংশীদার তথা ভাইস-প্রেসিডেন্টের পদে নির্বাচিত কমলা হ্যারিসও। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছনোর আনন্দে যেন সঙ্গীতের ছন্দে তাল মিলিয়েছেন তাঁরা দু’জনা।
নির্বাচনের প্রচারে বেরিয়ে প্রথম থেকেই আমেরিকার সব মানুষের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি শোনা গিয়েছে বাইডেন-হ্যারিস জুটির মুখে। তার ফলও পেয়েছেন তাঁরা। দেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভোটে পেয়েছেন বাইডেন-হ্যারিস। নয়া জুটির সাফল্যে লস এঞ্জেলসের রাস্তায় নেমে পড়েছেন উচ্ছ্বসিত সমর্থকেরা।
পরাজয়ের পরের দিনই যেন খানিকটা বেপরোয়া মনোভাব ডোনাল্ড ট্রাম্পের। আমেরিকা জুড়ে ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের উল্লাসের মাঝেই হোয়াইট হাউসে গল্ফে মেতেছেন তিনি। এই নির্বাচনী লড়াই যে এখনও বাকি, সে বিবৃতিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
এ দিন বিজয়ীর ভাষণে একে অপরকে ফের একটা সুযোগ দেওয়ার কথা শোনা গিয়েছে বাইডেনের মুখে। বিরোধী রিপাবলিকানদের দিকেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। আমেরিকার রাস্তাতেই মিলেমিশে আনন্দে মেতেছেন আম জনতা।
ব্যলটে যাঁরা সমর্থন জানাননি, তাঁদের হয়েও আগামী ৪ বছর কাজ করার অঙ্গীকার করতে শোনা গিয়েছে বাইডেনের কণ্ঠে। ডেলাওয়্যারের সভায় তাঁর ভাষণ শুনে আপ্লুত জনতা রব তুলেছে, বা-ই-ডে-ন।
হোয়াইট হাউসের লড়াইয়ে তুঙ্গে ওঠার আগে আমেরিকার মাটিতে ঘটে গিয়েছে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের খুনের ঘটনা। এতে আমেরিকার সমাজে নিহিত বর্ণবৈষম্যের নির্মম সত্য ফের প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। গোটা বিশ্বের কাছে উত্তাল করা ওই ঘটনা নিয়ে ট্রাম্পের কণ্ঠে সহানুভূতি বা নিন্দার কোনওটাই শোনা যায়নি। অনেকের মতে, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসকেই যেন অবহেলা করা হয়েছে তাতে।
কমলা দেবী হ্যারিসকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করার মধ্যেই দিয়েই সমাজের একটি বড় অংশের কাছে যেন বার্তা দিতে চেয়েছেন বাইডেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত-আমেরিকান, এশীয়, হিসপ্যানিক, অভিবাসী অথবা এলজিবিটি সম্প্রদায়— সমাজের সকল পক্ষের হয়ে মুখ খুলেছেন বাইডেন-হ্যারিস জুটি।
আমেরিকার প্রথম মহিলা ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর আম জনতার উদ্দেশে কমলা হ্যারিস বলেছেন, ‘‘আশাভরসা, বিজ্ঞান, সংঘবদ্ধতা এবং সত্যকেই বেছে নিয়েছেন আপনারা।’’ এই ঘটনা যে আমেরিকার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে, তা-ও মনে করছেন সমর্থকেরা।
করোনার মতো অতিমারি নিয়ে ট্রাম্পের লাগামছাড়া মনোভাবও তাঁর বিপক্ষে গিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। মাস্ক পরা নিয়ে তাঁর বিরূপ মনোভাব অথবা আমেরিকায় সংক্রমণে রাশ টানতে ব্যর্থতাকেই ডেমোক্র্যাটরা ভোট জয়ে হাতিয়ার করেছেন।
করোনা পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ ট্রাম্পের বদলে বাইডেন-হ্যারিস জুটি যে সমর্থ হবেন, সে ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী আমেরিকার ভাবী ভাইস-প্রেসিডেন্ট। আমেরিকা যে নতুন পথে চলতে প্রস্তুত, সে বিষয়েও আশাবাদী কমলা।
আমেরিকার নির্বাচন বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করতে বাইডেনের হাতে ৫টি অস্ত্র কাজে এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল, করোনা পরিস্থিতি সামলানো নিয়ে ২ নেতার দক্ষতা। ওয়াশিংটনের পিউ রিসার্ট সেন্টারের সমীক্ষায় দাবি, এ প্রসঙ্গে ভোটের আগে ট্রাম্পের থেকে ১৭ শতাংশ এগিয়ে ছিলেন বাইডেন।
৩ বারের প্রচেষ্টার পর ওভাল অফিসে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন বাইডেন। অনেকের মতে, কোনও রকম শোরগোল ছাড়াই ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনে প্রচার করে যাওয়াটাও বাইডেনকে সাফল্য এনে দিয়েছে। ট্রাম্পের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ বা প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে কটূক্তির পরিবর্তে নিজেদের প্রতিশ্রুতিগুলি ভোটারদের কাছে তুলে ধরেছেন বাইডেন-হ্যারিস। অনেকের মতে, সমাজের বড় অংশের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে।
বাইডেনের জয়ের পথে কাজে এসেছে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াও। ৪ বছরে মেরুকরণের রাজনীতি, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাবের জবাবে বিরোধী পক্ষকে নিজেদের শত্রু না ভাবার বাইডেনের নীতির প্রশংসা করেছেন অনেকেই। ব্যালটের তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
উদারনীতির বদলে মধ্যপন্থার পথ বেছে নেওয়াটাও বাইডেনের জয়ের পথ মসৃণ করেছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকদের একাংশ। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ বা বিনামূল্যে কলেজ শিক্ষাদানের মতো নীতি বেছে নেননি বাইডেন। এর ফলে সমাজের একটি বড় অংশের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে।
প্রায় প্রতিটি ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছেন বাইডেন। লকডাউনে ঘরবন্দি ভোটারদের আরও কাছে পৌঁছেছেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে হোয়াইট হাউস ছিনিয়ে নিলেও বিরোধী পক্ষকে শত্রু ভাবতে নারাজ জো বাইডেন। বরং জেতার পর প্রথম ভাষণেই বিভাজনের রাজনীতিকে দূরে ঠেলে সংঘবদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার শোনা গিয়েছে তাঁর কণ্ঠে। ডেমোক্র্যাটদের নীল বা রিপাবলিকানদের লাল রঙে রাঙানো কতগুলি রাজ্য নয়, আমেরিকাকে অখণ্ড রাষ্ট্র হিসাবেই দেখেন বলেও জানিয়েছেন জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র।
শুধুমাত্র সমর্থকেরাই নন, রানিং মেট হিসাবে একজন মহিলাকে বেছে নেওয়ার জন্য বাইডেনের সাহসের তারিফ করেছেন কমলাও।
নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে ট্রাম্পের বেপরোয়া মনোভাবকে বিশেষ গ্রাহ্যের মধ্যে আনছেন না ডেমোক্র্যাটরা। বিজয়ীর ভাষণ দিতে গিয়ে সমর্থকদের পাশাপাশি মুহূর্তের জন্য হলেও বাইডেনকেও দেখা গিয়েছে হাল্কা মেজাজে।
বাইডেন-হ্যারিস জুটি যে আমেরিকাকে নয়া উচ্চতায় নিয়ে যাবে, সে বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী বহু সমর্থক। ডেলাওয়্যারে বহু দর্শকের চোখে দেখা গিয়েছে আনন্দাশ্রু। ছবি: গেটি ইমেজেস, রয়টার্স এবং এএফপি।