১৯৮০-এর পর থেকে স্মৃতির ঝুলি খালি। বয়স আটকে সেই চব্বিশেই। ভয়ঙ্কর এক গাড়ি দুর্ঘটনা তাঁর জীবনের ৩৯ বছরের সমস্ত স্মৃতি মুছে দিয়েছে। লুসিয়ানো ডি’আদামোর শেষ যে দিনটি স্মরণ করতে পারেন তা ১৯৮০ সালের মার্চ মাসের।
সেই দুর্ঘটনার পর ২০১৯ সালে যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠেন লুসিয়ানো। বিগত চার দশকের কোনও স্মৃতি আর তিনি খুঁজে পাননি। ৬৮ বছর বয়সে যেন নতুন এক জীবন শুরু হয় লুসিয়ানোর।
দুর্ঘটনার আগে লুসিয়ানোর শেষ স্মৃতি ছিল ১৯৮০ সালের ২০ মার্চ ফিউমিসিনো বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড অপারেশন অফিসার হিসাবে কাজ করা। তার পর থেকে সমস্ত বেবাক ফাঁকা।
এক গাড়ি দুর্ঘটনার ফলে এই অবস্থা হয়ে যায় লুসিয়ানোর। মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং তার পর কোমায় চলে যান তিনি। কোমা থেকে জেগে ওঠার পরে সেরে উঠেও যিনি মানতে পারেননি মাঝখানে এতগুলো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কারণ তাঁর স্মৃতি আটকে ছিল ৪০ বছর আগে।
লুসিয়ানো মনে করেছিলেন তাঁর বয়স ২৪। নিকটতম এবং প্রিয়জনেরা তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন। এমনকি নিজের স্ত্রীকেও চিনতে পারেননি তিনি।
লুসিয়োনা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘‘প্রতি দিনই রাস্তায় এমন লোকের সঙ্গে দেখা হয় যাঁরা আমাকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি হতে পারেন আমার এক জন পুরনো বন্ধু। কিন্তু আমি জানি না তিনি কে। তবুও সৌজন্যের কারণে আমি তাঁকে চেনার ভান করি এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করি।’’
কোমা থেকে জেগে উঠে আয়নার দিকে তাকিয়ে প্রথমে নিজেকেও চিনতে পারেননি লুসিয়ানো। মনের দিক থেকে ২৪ বছরের এক তরতাজা যুবকের ৬৮ বছরের বৃদ্ধের চেহারা! মাথায় সাদা চুল ও সারা মুখে বলিরেখা। কোনও ভাবেই নিজের বয়স যে বেড়েছে তা স্বীকার করতে চাননি লুসিয়ানো।
এমনকি হাসপাতালে নিজের স্ত্রীকে দেখেও মানতে চাননি তিনি বিবাহিত। দুর্ঘটনা ঘটার আগে তাঁর বর্তমান স্ত্রী লুসিয়োনার বাগ্দত্তা ছিলেন। ১৯ বছরের সেই তরুণী প্রণয়ীর ছবি স্মৃতিতে আটকে রয়েছে লুসিয়োনার। যাঁকে তিনি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ৩৯ বছর আগে।
কোমা থেকে জেগে ওঠার পর পরই তিনি নিজের মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চেয়েছিলেন। তাঁকে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা দেখে তিনি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন।
আশির দশকে আটকে থাকা লুসিয়োনা জানতেন না মোবাইল বা জিপিএস কী বস্তু! সকলের হাতে মোবাইল দেখে বিস্মিত হন তিনি।
কোমা থেকে বেরিয়ে আসার পর তিনি ৩০ বছরের পুত্রসন্তানকে প্রথম বার দেখেন। নিজের মায়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেও তা আর সম্ভব হয়নি। কারণ তাঁর মা তত দিনে মারা গিয়েছেন।
পুরনো স্মৃতি তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ছোটদের সঙ্গে তাল মেলাতে কোনও সমস্যা হয়নি ইতালির বাসিন্দা লুসিয়োনার। এটি তাঁর চিকিৎসার অঙ্গ। একজন বয়স্ক ব্যক্তি হিসাবে তাঁকে সামাজিক রীতিনীতি শিখতে যে সাহায্য দরকার তা শিশুদের সান্নিধ্যেই সম্ভব বলে মনে করেছিলেন তাঁর চিকিৎসকেরা।
সম্প্রতি ইতালির সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, তাঁর মাঝেমাঝে বিমানে চড়ার ইচ্ছা হয়। কারণ তিনি মনে করেন তিনি কোনও দিন বিমানযাত্রা করেননি। অথচ তাঁর স্ত্রী জানান তাঁরা দুজনে বিমানে করে প্যারিস ভ্রমণ করেছিলেন দুর্ঘটনার ঘটার আগে।
লুসিয়ানো এখন একটি স্কুলে কাজ করেন। আধুনিক রীতিনীতি এবং প্রযুক্তির সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হতে শুরু করেছেন তিনি।
চিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীরা লুসিয়ানোর স্ত্রী এবং ছেলের সঙ্গে গত পাঁচ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন যাতে তাঁর স্মৃতি এই ৪০ বছরের ফাঁক কাটিয়ে উঠতে পারে।
দুর্ঘটনার জন্য লুসিয়ানো অবশ্য এখনও কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি। ঠিক কী ঘটেছিল, তার কোনও ধারণাও নেই লুসিয়ানোর। মনে করা হয়, তাঁকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির চালক পালিয়ে যান। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।