আর সদা ব্যস্ত সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত নয়। সমুদ্রে এ বার নতুন ‘বাইপাস’ ব্যবহার শুরু করল ভারত। ফাঁকায় ফাঁকায় অল্প সময়ে সেই রাস্তা দিয়ে পৌঁছনো যাবে রাশিয়া। এই ‘বাইপাস’ ভারতের অর্থনীতির জন্য নতুন মাইলফলক হতে চলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর ‘সাগর মন্থন’ সম্মেলনে বক্তৃতা দেন কেন্দ্রীয় বন্দর, নৌপরিবহণ এবং জলপথমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। সেখানে ‘চেন্নাই-ভ্লাদিভস্তক সামুদ্রিক করিডর’ (সিভিএমসি) পুরোপুরি ভাবে চালু হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। ভারত-রাশিয়া বৈদেশিক বাণিজ্যের এই রুট যে আগামী দিনে ‘খেলা ঘোরাবে’ তা বলাই বাহুল্য।
এত দিন পর্যন্ত ইউরোপে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুয়েজ খাল ব্যবহার করে এসেছে নয়াদিল্লি। এই রাস্তায় রাশিয়া পৌঁছতে ভারতীয় জাহাজগুলি সময় নিয়ে থাকে অন্তত ৪০ দিন। এর বিকল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল চেন্নাই-ভ্লাদিভস্তক সামুদ্রিক করিডর। এর ফলে রাশিয়া যাওয়ার সময় এবং খরচ দুটোই বাঁচাতে পারবে নয়াদিল্লি।
সুয়েজ খাল দিয়ে ইউরোপে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে এ দেশের জাহাজগুলিকে পাড়ি দিতে হয় ৮ হাজার ৬৭৫ নটিক্যাল মাইল। অর্থাৎ ১৬ হাজার ৬৬ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় তাদের। উপরন্তু মিশরের নিয়ন্ত্রণে থাকা সুয়েজ খাল দিয়ে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য মোটা টাকা ফি নিয়ে থাকে কায়রো। জাহাজপিছু যা প্রায় ৭০ হাজার ডলার।
অন্য দিকে, জলপথে চেন্নাই থেকে পূর্ব রাশিয়ার শহর ভ্লাদিভস্তকের দূরত্ব ৫ হাজার ৬৪৭ নটিক্যাল মাইল। অর্থাৎ এই রাস্তায় ভারতীয় জাহাজকে মালপত্র নিয়ে ১০ হাজার ৪৫৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। ফলে অর্ধেক সময়ে (১৬ থেকে ২০ দিনের মধ্যে) পৌঁছনো যাচ্ছে ইউরোপ।
সুয়েজ খালের দ্বিতীয় সমস্যা হল পশ্চিম এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যখন-তখন এটিকে বন্ধ করতে পারে মিশর। অতীতে বেশ কয়েক বার সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে নয়াদিল্লি। খালটি বন্ধ থাকলে ইউরোপে পৌঁছনো ভারতের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। চেন্নাই-ভ্লাদিভস্তক সামুদ্রিক করিডরে সেই সমস্যা মিটল বলে জানিয়েছেন সোনওয়াল।
রুশ শহর ভ্লাদিভস্তকের একাধিক কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। এখানেই রয়েছে মস্কোর প্রশান্ত মহাসাগরীয় সবচেয়ে বড় সমুদ্র বন্দর। ভ্লাদিভস্তক থেকে চিন সীমান্তের দূরত্ব মেরেকেটে ৫০ কিলোমিটার। জাপান সাগর, দক্ষিণ চিন সাগর, মলাক্কা প্রণালী, বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান ও নিকোবরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক এলাকাকে অতিক্রম করে এই পথ।
এই রাস্তায় যুক্ত রয়েছে ওড়িশার পারাদ্বীপ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম সমুদ্র বন্দর। ফলে এই দু’টি জায়গা থেকেও সিভিএমসির মাধ্যমে সহজেই রফতানি সামগ্রী রাশিয়া নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এই করিডর ভারতের উপস্থিতিকে আরও মজবুত করল বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সস্তা দরে মস্কো থেকে খনিজ তেল আমদানি করে চলেছে নয়াদিল্লি। নতুন সামুদ্রিক রুটে সেই ‘তরল সোনা’-সহ অন্যান্য সামগ্রী এ দেশে আনা শুরু হয়েছে। অন্য দিকে বস্ত্র, ফার্মা, চা, মেশিনের যন্ত্রপাতি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রীর মতো রফতানি পণ্য নতুন রাস্তায় পাড়ি দিচ্ছে রাশিয়া।
কৌশলগত দিক থেকে চেন্নাই-ভ্লাদিভস্তক সামুদ্রিক করিডরকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। মিশরের সঙ্গে বর্তমানে চিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে আগামী দিনে বেজিংয়ের কথায় ভারতের জন্য সুয়েজ খালের দরজা বন্ধ করতেই পারে কায়রো। তখন ইউরোপে বাণিজ্য করতে না পেরে পঙ্গু হয়ে পড়তে পারে এ দেশের অর্থনীতি।
আর সেই কারণে দীর্ঘ দিন ধরেই বিকল্প পথের সন্ধান করছিল নয়াদিল্লি। অবশেষে চেন্নাই-ভ্লাদিভস্তক সামুদ্রিক করিডরের মাধ্যমে লক্ষ্যপূরণ হল বলে জানিয়েছে ওয়াকিবহাল মহল। এই সমুদ্রপথ রুশ অর্থনীতিতেও গতি আনবে। এর মাধ্যমে দূর প্রাচ্যের মূল জ্বালানি সরবরাহকারী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে মস্কোর।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সোনওয়াল বলেছেন, ‘‘এই সামুদ্রিক করিডরের মাধ্যমে ভারত এবং রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন করে সংজ্ঞায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মাধ্যমে পশ্চিমের আধিপত্য এবং ঐতিহ্যগত সরবরাহ শৃঙ্খলের (সাপ্লাই চেইন) উপর নির্ভরতা কমাতে পেরেছি আমরা।’’
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত সফরে আসেন রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী ডেনিস মান্টুরভ। মুম্বইয়ে ভারত-রাশিয়া বাণিজ্যিক ফোরামের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। নয়াদিল্লির সঙ্গে আমদানি-রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছেন মান্টুরভ। বর্তমানে মস্কোর সঙ্গে যে বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে, তা মেটানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্র।
২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য ১০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে নয়াদিল্লি। চেন্নাই-ভ্লাদিভস্তক সামুদ্রিক করিডর সেই স্বপ্ন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে বলে জানিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। মস্কোর সঙ্গে এই নিয়ে দ্বিতীয় বাণিজ্যিক করিডর খুলল নয়াদিল্লি।
এ বছরের জুনে রুশ শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ট্রেনে করে ভারতে কয়লা পাঠায় মস্কো। ‘আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডর’ (ইন্টারন্যাশনাল নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর বা আইএনএসটিসি) হয়ে যা পৌঁছয় মুম্বই বন্দরে। এই করিডর প্রায় ৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার (সাড়ে চার হাজার মাইল) লম্বা।
রেল, সড়ক ও নৌপরিবহণ— এই তিনের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আইএনএসটিসি। এই পথে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে পণ্য মধ্য এশিয়া হয়ে প্রথমে আসছে ইরানের চাবাহার বন্দরে। পরে সেখান থেকে জলপথে তা আনা হচ্ছে মুম্বই বন্দরে। তবে এই পথেও অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল মস্কো ও নয়াদিল্লি।
গত বছর (পড়ুন ২০২৩) নয়াদিল্লিতে হওয়া ‘জি-২০’ সম্মেলনে ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সংযোগকারী আরও একটি করিডর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুম্বই থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম এশিয়ার উপর দিয়ে ভুমধ্যসাগর হয়ে ওই রাস্তায় পৌঁছনো যাবে গ্রিস। এর পোশাকি নাম ‘ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর’ (আইএমইসি) রাখা হয়েছে।
এই রাস্তায় মুম্বই এবং গুজরাতের মুন্দ্রা বন্দরের সঙ্গে জলপথে যুক্ত হবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। সেখান থেকে রেলপথে সৌদি আরব এবং জর্ডন হয়ে পণ্য পৌঁছবে ইজ়রায়েলের হাইফা বন্দরে। এর পর আবার ভুমধ্যসাগর হয়ে গ্রিসের পিরাইউস্ বন্দরে পৌঁছবে রফতানি সামগ্রী।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া থেকে ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালায় ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হামাস’। এর পরই পশ্চিম এশিয়ার ওই এলাকায় শুরু হয়েছে যুদ্ধ। ফলত, আইএমইসি দিয়ে যে দ্রুত পণ্য পরিবহণ শুরু হচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য।