আবু বকর আল বাগদাদি। —ফাইল চিত্র
কায়লা মুলার। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিরিয়ায় খুন হয়েছিলেন এই মার্কিন মানবাধিকার কর্মী। আইএস জঙ্গি সংগঠনের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির মৃত্যুর পর ফের উঠে আসছে মার্কিন নাগরিক কায়লা মুলারের নাম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিরিয়ায় মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করতে যান কায়লা। কিন্তু তাঁকে অপহরণ করে আইএস জঙ্গিরা। জানা যায়, তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করে খোদ আইএস প্রধান বাগদাদি। রবিবার আইএস প্রধানের বিরুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর এই অপারেশন উৎসর্গ করা হয়েছে অ্যারিজোনার বাসিন্দা সেই কায়লা মুলারকেই।
ওয়ার রুমে বসে বাগদাদির ঘাঁটিতে মার্কিন বাহিনীর অভিযানের দৃশ্য লাইভ দেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাতে ‘উচ্ছ্বসিত’ তিনি। সেই অভিজ্ঞতা কেমন তা-ও জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘মনে হচ্ছিল যেন সিনেমা দেখছি।’’ যে উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় ওই অভিযান চালিয়েছে আমেরিকা, সেই প্রযুক্তির তারিফ করেন তিনি।
গাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন: লাইনে আগুন, রবীন্দ্র সদন স্টেশন ভরে গেল ধোঁয়ায়, বিপর্যস্ত মেট্রো পরিষেবা
২০১৪ সালে নিজেকে ‘খলিফা’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল আইএস-এর প্রধান বাগদাদি। সেই সময় থেকেই ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় ছিল সে। গত পাঁচ বছর ধরে তার পিছু পিছু ঘুরছেন মার্কিন বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। দীর্ঘ চেষ্টার পর অবশেষে সাফল্য পেলেন তাঁরা। লাগাতার অভিযানে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল আইএস। ক্রমশ জায়গা বদলে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল বাগদাদিও। আর তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল মার্কিন বাহিনী।
বেশ কয়েকদিন ধরেই তার গতিবিধির উপরে নজর রাখছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা। বলা ভাল, আইএস প্রধানের খোঁজ পেতে হন্যে ঘুরছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত ‘টিপ’টা আসে ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে থাকা কুর্দ বাহিনী থেকেই। বৃহস্পতিবার মার্কিন গোয়েন্দারা খবর পান বাগদাদিকে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইডলিবে পাওয়ার ‘প্রবল সম্ভাবনা’ রয়েছে। শুক্রবারের মধ্যেই সেনা অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে মার্কিন প্রশাসন। শনিবার সকালে ইডলিবে অভিযান চালানোর মতো ‘নির্ভরযোগ্য তথ্য’ পান মার্কিন গোয়েন্দারা। জানা যায়, ইডলিবের বারিশা এলাকায় আইএসের ওই ঘাঁটিতে সপরিবারে রয়েছে বাগদাদি। তার সঙ্গে রয়েছে এক দল আইএস জঙ্গিও।
মার্কিন প্রশাসনের অন্দরে যে এমন ‘ঝড়ের প্রস্তুতি’ চলছে তা কোনওভাবেই আগাম টের পাওয়া যায়নি। বাগদাদির বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি যখন চলছে তখন, শুক্রবার রাতে মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প ও জামাই জারেদ কুশনেরের দশম বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।শনিবার সকালে ভার্জিনিয়ায় গলফ খেলতেও যান তিনি। সেখান থেকে, বিকেলের দিকে সরাসরি ওয়ার রুমে ঢুকে পড়েন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। গোটা ওয়াশিংটনবাসী তখন ন্যাশনাল পার্কে ওয়াশিংটনের সঙ্গে হিউস্টনের টানটান বেসবল ম্যাচে মজে ছিল।
আরও পড়ুন: একসঙ্গে নয়, মহারাষ্ট্রে রাজ্যপালের সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা করল বিজেপি-শিবসেনা
ওয়াশিংটন থেকে ছয় হাজার মাইল দূরে তখন বাগদাদির বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন সেনা। সেই বাহিনীতে যোগ দেয় আমেরিকার বিখ্যাত ডেল্টা ফোর্সও। সেনাকর্তাদের সবুজ সঙ্কেত পেতেই রবিবার ভোর রাতে পশ্চিম ইরাকের আল আসাদ বিমানবন্দর থেকে উড়ান শুরু করে আটটি হেলিকপ্টার। তার মধ্যে ছিল মার্কিন সিএইচ-৪৭ কপ্টারও। এই অভিযানের সময় সিরিয়া ও রুশ আকাশসীমার উপর দিয়ে যেতে হয়েছে মার্কিন কপ্টারগুলিকে। তবে সেই আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতিও পেয়েছেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, ঘণ্টা খানেকের অভিযানেই শেষ হয়ে যায় গোটা দুনিয়ার ত্রাস, আইএস জঙ্গি প্রধান আবু বকর আল বাগদাদি। মার্কিন বাহিনীর হামলার তীব্রতার সামনে ভেঙে পড়ে আইএস প্রধানের প্রতিরোধ। তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাগদাদির দেহরক্ষীদের মধ্যে। আক্রমণের তীব্রতা কেমন ছিল তা উঠে এসেছে বারিশা এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়। পরিচয় জানাতে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী বলেন, ‘‘আমরা ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলাম গুলিবৃষ্টি চলছে। তাই আমরা ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে পড়লাম।’’ এর পরেই বাগদাদির ডেরায় একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। বুবি ট্র্যাপ থাকতে পারে এমন আশঙ্কায় বাগদাদির আস্তানার একের পর দরজা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেন মার্কিন বাহিনীর সদস্যরা। একে একে ওই ঘঁটিতে থাকা আইএস জঙ্গি এবং বাগদাদির দেহরক্ষীরাও মারা পড়ে। অনেককে গ্রেফতারও করে মার্কিন বাহিনী।
সিরিয়ার ইডলিবের বারিশা গ্রাম। ছবি: এএফপি
শেষ পর্যন্ত পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে বাগদাদি। কম্পাউন্ডে থাকা লুকনো সুড়ঙ্গ পথ ধরে পালানোর চেষ্টা করে সে। তিন সন্তানকেও টেনে হিঁচড়ে সঙ্গে নিয়ে যায় আইএস প্রধান। সর্পিল সেই সুড়ঙ্গ পথে তার পিছনে ধাওয়া করে মার্কিন সেনাও। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, গোটা রাস্তাটাই গোঙাচ্ছিল বাগদাদি। সে মাঝে মাঝে চিৎকার করছিল এবং কাঁদছিলও। কিন্তু, এক সময় সুড়ঙ্গও শেষ হয়ে যায়। সে সময় সুইসাইড ভেস্ট (বোমা বাঁধা পোশাক)-এর মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটায় সে। মুহূর্তেই বাগদাদি ও তার সন্তানদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথায়, শেষ পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বাগদাদির সামান্য দেহাংশ খুঁজে পায় মার্কিন বাহিনী। কিন্তু, এর পরেও বাগদাদির মৃত্যু নিয়ে সন্দিহান ছিল মার্কিন বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে মেলা দেহাংশের ডিএনএ পরীক্ষা করে বাগদাদির মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন তাঁরা। জানা গিয়েছে, গোটা অপারেশন শেষ হওয়ার পর অন্তত দু’ঘণ্টা বাগদাদির গুপ্ত আস্তানায় তল্লাশি চালায় মার্কিন বাহিনী। সেখান থেকে আইএস-এর প্রচুর নথি উদ্ধার হয়েছে। তাতে জঙ্গি সংগঠনটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কিত নানা নথিপত্র রয়েছে বলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি। বাগদাদির ওই আস্তানা থেকে কয়েক জন শিশুকেও উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে বাহিনী ফিরে আসতেই তা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মার্কিন জেট বাহিনী বাগদাদির ওই গুপ্ত ঘাঁটি লক্ষ করে ছটি রকেট বিস্ফোরণ ঘটায়। তাতে গোটা এলাকাই কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন সূত্রে খবর, বাগদাদির দেহ প্রথা মেনেই সমাধি দেওয়া হবে, ঠিক যেমন ভাবে সলিল সমাধি দেওয়া হয়েছিল আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের দেহ।
আরও পড়ুন: কুকুরের মতো মরেছে বাগদাদি, বেশ কয়েক ঘণ্টার জল্পনার পর ঘোষণা মার্কিন প্রেসিডেন্টের
২০১১ সালে ৯/১১ হামলার মূলচক্রী আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে খতম করে মার্কিন নেভি সিল। সে সময় আমেরিকার ক্ষমতায় ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালীনই আইএস প্রধান বাগদাদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ময়দানে নেমেছিল মার্কিন বাহিনী ও গোয়েন্দারা। সেই সাফল্য এল আট বছরের মাথায়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।