শান্তিনিকেতনে আলোচনাসভায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
অসাম্য ও অপচয়। জল নিয়ে এই দুই বিপরীতমুখী বাস্তবের সহাবস্থান রয়েছে সমাজে। যদিও তার চর্চা নেই জনপরিসরে। শান্তিনিকেতনে শিল্প প্রদর্শনীতে এসে সেই চর্চা এবং জল নিয়ে যথাযথ সরকারি নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবারের শান্তিনিকেতন সাক্ষী থাকল শিল্পকর্ম ও রন্ধনচর্চা নিয়ে তাঁর ভাবনারও।
যে জলকে বলা হয় জীবন, তা-ই ছিল ‘বেঙ্গল বিয়েনেল’-এর একটি আলোচনাচক্রের বিষয়। সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে গ্রাফিক নভেলিস্ট সারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিজিতের তৈরি একটি ভিডিয়ো। তা নিয়েই এ দিন চলে কথাবার্তা। ছিলেন প্রদর্শনীর কিউরেটর, কলাভবনের শিক্ষক অংশুমান দাশগুপ্ত। আলোচনার সূত্রধর ছিলেন মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আলোচনার মঞ্চে অভিজিৎ বলেন, “জল নিয়ে ভীষণ অসাম্য ও অপচয় রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রবল জলসঙ্কট। কিন্তু জনপরিসরে এ নিয়ে আলোচনাই হয় না। এটা সবাই জানে যে, জল ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। কিন্তু আবার এটাও বাস্তব, বহু মানুষকে কার্যত জল ছাড়াই বাঁচতে হয়। তাঁদের পরিষ্কার, পরিস্রুত জল পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। তাই তাঁরা সে ভাবেই বাঁচতে বাধ্য হন।”
তাঁর আক্ষেপ, “আমার মনে হয় সমাজ এখনও এই সত্যিটা গ্রহণ করেনি যে, জল পাওয়ার অধিকার নিয়ে ভয়ঙ্কর অসাম্য রয়েছে। এই পরিস্থিতি ক্রমশও আরও খারাপ হচ্ছে। শীত পেরোনোর পর আরও বোঝা যাবে, যাঁরা নাগরিক পরিসরের বাইরে থাকেন, তাঁদের অনেকের পরিস্রুত জল পাওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।”
কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে নগরায়ণের ফলে প্রকৃতি ধ্বংস নিয়ে চর্চা বহু দিনের। অভিজিৎ বলেন, “নির্মাণশিল্পের যে ধুম, যা শান্তিনিকেতনেও চোখে পড়ে, তা-ও এই জলসঙ্কটের সঙ্গে নানা ভাবে সংযুক্ত। এই নির্মাণশিল্প আবার যেমন জলের চাহিদা তৈরি করে, তেমনই তার কারণে জলমগ্ন হওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়। এই সব ভাবনা নিয়েই আমি সারনাথের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এই কাজ তারই ফসল।”
রন্ধনচর্চা নিয়ে নিজের ভাবনাকেও যেন অর্থনীতি, সমাজ, পরিবেশের সঙ্গে মিশিয়ে দেন নোবেলজয়ী। তাঁর রান্না নিয়ে চর্চার কথা সুবিদিত। সম্প্রতি তাঁর একটি রান্নার বইও প্রকাশিত হয়েছে। জলসঙ্কটের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্কও ব্যাখ্যা করেন অভিজিৎ। তাঁর পর্যবেক্ষণ, বিরিয়ানি থেকে পোলাও— এ ধরনের রান্নায় এখন প্রধানত বাসমতী চাল ব্যবহার হয়। যা বাসমতীর চাহিদা বাড়িয়েছে। বেড়েছে উৎপাদনও। তাঁর কথায়, “বাসমতী উৎপাদনে প্রচুর জল লাগে। যা জলের সঙ্কটকে তীব্র করছে। বাসমতী ছাড়াও স্থানীয় নানা চালে বিরিয়ানি বা পোলাও রান্না সম্ভব। কিন্তু এ নিয়ে সচেতনতা নেই।”
এ ক্ষেত্রে সরকারও যে দায়িত্ব এড়াতে পারে না, মনে করিয়ে দেন অভিজিৎ। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি নীতিতে চাল ও গমের উৎপাদন বাড়াতে জোর দেওয়া হয়েছে। তাই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান ও গম কেনা হয়, পঞ্জাবের মতো বেশ কয়েকটি রাজ্যে চাষিদের জন্য বিনামূল্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তাতে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার বেড়েছে। ফলে, জলস্তর ক্রমেই নামছে।
অভিজিৎ বলেন, “এই ধরনের অনুষ্ঠান, আলোচনার মাধ্যমে জলের অধিকার নিয়ে এই চর্চা শুরু হতে পারে, যা এত দিন শুরু হয়নি। এটা শুধু কোনও একটা-দু’টো ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় নয়, এ নিয়ে ধারাবাহিক নীতি দরকার।”