ছবি সংগৃহীত।
টানা পাঁচ দিন পাঁচ রাত বিমানবন্দরের বাইরে বসে ছিলেন শগুফতা দস্তগির। কিন্তু প্রয়োজনীয় অনুমতি-পত্র মেলেনি। তারপরেই বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলা সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ভাগ্য ভাল সেই মুহূর্তে বিস্ফোরণস্থলের কাছাকাছি ছিলেন না তিনি। তখনই ঠিক করেন, আর নয়। ফিরে যাবেন নিজের গ্রামে। হাতে তুলে নেবেন ছুরি-কাঁচি। আবার শুরু করে দেবেন ধাই মায়ের কাজ।
আজ তালিবানও টুইটারের বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, সরকারি মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন কাজে ফেরেন। তালিবানের প্রধান মুখপাত্র জ়বিউল্লা মুজাহিদকে উদ্ধৃত করে আর এক মুখপাত্র সুহেল শাহিন টুইটারে লিখেছেন, ‘‘দেশের রাজধানী ও প্রাদেশিক রাজধানীর সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে যে সব মহিলা কাজ করেন, তাঁরা যেন অবিলম্বে কাজে যোগ দেন এবং আগের মতোই নিয়মিত কাজ করে যান। ইসলামিক আমিরশাহি (তালিবান এই নামেই নিজেদের সরকারকে চিহ্নিত করে) তাঁদের কাজে কোনও বাধা দেবে না।’’
অতিমারির আবহে ও এই যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার অবস্থা একদমই ভাল নয়। ১৫ অগস্ট কাবুল পতনের পর থেকে দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। আর ভয়ে কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অধিকাংশ মহিলা। এই পরিস্থিতিতে সরকারি মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়ে তালিবান যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।
কিন্তু দিন কয়েক আগেই যে জ়বিউল্লা বলেছিলেন, ‘‘মেয়েদের বাড়িতে থাকাই ভাল, কারণ আমাদের সেনাদের রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখার অভ্যাস নেই!’’ আজ তালিবান মুখপাত্রকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘সে দিনের নিদান নেহাতই সাময়িক ছিল। তখনই সেটা উল্লেখ করেছিলাম।’’ মেয়েরা তা হলে এখন বাইরের জগতে পা রাখতেই পারেন? প্রশ্নকর্তাকে জ়বিউল্লার সংক্ষির্ত জবাব— ‘‘শরিয়ত মেনে।’’
কিন্তু ঠিক কী ভাবে শরিয়ত মানা হবে, তার কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা দেননি জ়বিউল্লা বা অন্য কোনও তালিবান নেতা। ফলে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছেন না শগুফতারা। তাঁর মতোই গত কয়েক দিন ধরে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করে করে ফিরে এসেছেন শিরিন তবরিক। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে থেকে নিজেকে ‘শরণার্থী’ প্রমাণ করায় ব্যর্থ হয়েছেন তিনিও, ফলে বিদেশি বিমানে ওঠার সুযোগ শিকেয় ছেঁড়েনি। শগুফতার মতো তাই পেশায় শিক্ষক শিরিনও এ বার ঠিক করেছেন, ফিরে যাবেন দেশের বাড়িতে।
শগুফতা বা শিরিন কোনও বিচ্ছিন্ন দু’টি উদাহরণ নন। আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে এখন এ রকম হাজার হাজার মহিলা রয়েছেন, যাঁরা কিশোরী বেলায় তালিবান-রাজ দেখেছিলেন। এবং দেখেছিলেন বলেই জানেন, নারী স্বাধীনতার বিষয়ে কতটা নির্মম হতে পারে তালিবান। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এই পাঁচ বছরে তারা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো দূর অস্ত্। কোপ পড়েছিল মেয়েদের কর্মজীবনেও। কিন্তু গত দু’দশক ধরে ছবিটা পাল্টেছে। বাইরের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন আফগান, বিশেষত, শহুরে আফগান মেয়েরা। এখন তালিবান ফিরে আসায় তাই আতঙ্কে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন শিরিনরা। কিন্তু পারছেন কই!
শগুফতার স্বামী গনি প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন। এ মাসের প্রথম দিকে, কাবুল-পতন অনিবার্য বুঝেই, প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিলেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শগুফতার স্বামীও। আপাতত তিনি পাকিস্তানে। সেখান থেকে তিনি স্ত্রীকে পাকিস্তানে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় নথি মিলছে না।
এক বার ঘর পুড়তে দেখেছেন আফগান মেয়েরা। তাই তালিবানি সিঁদুরে মেঘে বড়ই ভয় তাঁদের! উপায়ন্তর না থাকায় আপাতত ঠিকানা আফগানিস্তানই। বেঁচে থাকার রসদ বলতে শুধু একটুখানি আশা, সত্যিই হয় তো এই তালিবান-জমানা সেই সাবেক তালিবান-জামানার থেকে আলাদা হবে। বিশেষ করে আজকের কাজে ফেরার নির্দেশিকার পরে।