গত চার মাসে সারা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা কয়েক লক্ষে গিয়ে ঠেকেছে। আক্রান্ত প্রায় ৭০ লক্ষ! করোনা-উত্তর পৃথিবী বলে আদৌ কিছু থাকবে,সবকিছু কি আবার পুরনো অবস্থায় ফিরবে, নাকি অতিমারি সবকিছু বদলে দেবে, তা নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতা এবং মানবিকতার মধ্যে যখন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, ঠিক সেইসময় নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে উষ্ণতার পরশ ছড়িয়ে দিয়েছেন কিছু মানুষ।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই ধরনের কিছু ঘটনা আমাদের অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। দেখে নিন তেমনই কিছু ভাল খবর—
লকডাউনের মধ্যেও হাসপাতালে যাওয়া নিয়ে কিছু দিন আগেই নিজের এলাকায় অপদস্থ হতে হয় আরজি কর হাসপাতালের নার্স উমা অধিকারীকে। নিজের ৮ মাসের ছেলেকে বাড়িতে রেখে হাসপাতালে ডিউটি করতে গিয়েছিলেন তিনি। তার জন্য লেকটাউনের তেঁতুলতলার বাড়িতে তাঁকে ঢুকতে বাধা দিচ্ছিলেন স্থানীয়রা। গোটা পরিবারের ডাক্তারের সার্টিফিকেট জোগাড় করে, পুলিশের সাহায্য নিয়ে কোনও ভাবে সেই পরিস্থিতি সামাল দেন তিনি।
কিন্তু কাজের জায়গায় ব্যক্তিগত এই অভিজ্ঞতাকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি উমা। তাই সদ্য অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানপ্রসবের পর এক মহিলা যখন তাঁর সন্তানকে স্তন্যপান করাতে পারছিলেন না, খিদের জ্বালায় ছোট্ট শিশুটি যখন কেঁদেকেটে একসা, তখন তাকে নিজের বুকে টেনে নেন তিনি। নিজের সন্তানের বিপদের কথা না ভেবে অভুক্ত শিশুটিকে স্তন্যপান করান।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৮ মে হাসপাতালে নাইট ডিউটি করতে যান উমা। সেখানে লেবার পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে সদ্যোজাতটিকে কাঁদতে দেখেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, সন্তান প্রসব হয়ে গেলেও, শিশুটির মায়ের বুকে দুধ আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত অন্যান্য প্রসূতিরা স্তন্যপান করান। কিন্তু করোনা আতঙ্কে ওয়ার্ডে ভর্তি ৮ প্রসূতি সেই সাহস পাননি। তখন নিজেই এগিয়ে যান উমা।
উমা যখন শিশুটিকে স্তন্যপান করাচ্ছেন, তখন শান্তনু মাইতি তাঁকে ভিডিয়ো কল করেন, যাতে মাকে দেখে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে তাঁদের ছেলে। কিন্তু উমা ফোন কেটে দেন। মেসেজ করে অন্য একটি শিশুকে স্তন্যপান করানোর কথা জানান। তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শান্তনু। তবে তাঁকে উমা বোঝান যে, সমস্ত নিরাপত্তা অবলম্বন করছেন তিনি। তা প্রমাণ করলে নিজস্বী তুলেও স্বামীকে পাঠান।
নিজে থেকে এ কথা প্রকাশ করেননি উমা। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসকরা উমার এই সাহসিকতার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন। তাতে উমার প্রশংসা করেছেন আর জি করের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অব গায়নোকোলজি অ্যান্ড অবস্টারিকস তুলিকা ঝা। এমন ঘটনা নতুন কিছু না হলেও, ডিউটিতে থাকাকালীন এর আগে কোনও নার্সকে তিনি এমন পদক্ষেপ করতে দেখেননি বলে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন তিনি। সমাজে হেনস্থার শিকার হওয়া সত্ত্বেও নিজের কর্তব্যের বাইরে গিয়ে উমা যা করে দেখিয়েছেন, তা সর্বত্রই প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এক হাতে সার্ভিস বন্ধুকটা ধরে, অন্য হাতে দুধের প্যাকেট নিয়ে ট্রেনের সঙ্গে ছুটছেন এক আরপিএএফ কর্মী। চলতি সপ্তাহে এমনই দৃশ্যের সাক্ষী থাকল গোটা দেশ। ঘটনাটি ঘটেছে মধ্যপ্রদেশের ভোপালে। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল শ্রমিক স্পেশ্যাল একটি ট্রেন। সেই ট্রেনের এক যাত্রীর কোলের শিশু অভুক্ত ছিল। তার জন্য দুধের প্যাকেট পৌঁছে দিতেই দৌড় লাগান ওই আরপিএফ কর্মী।
জানা গিয়েছে, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে চার বছরের সন্তানকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে ফিরছিলেন সাফিয়া হাশমি। দীর্ঘ ট্রেন সফরে সন্তানকে দুধ কিনে খাওয়ানোর সুযোগ হয়নি তাঁর। জলে বিস্কুট ভিজিয়ে খাইয়ে কোনওরকমে শিশুটিকে থামিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সন্ধ্যার সময় ভোপালে পৌঁছে কয়েক মিনিটের জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল ট্রেনটি।
কিন্তু ট্রেন থেকে নামার সাহস পাচ্ছিলেন না সাফিয়া। জানলা দিয়ে প্ল্যাটফর্নের দোকানগুলির দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। সেইসময় আরপিএফ জওয়ান ইন্দ্র যাদব তাঁর নজরে পড়েন। ওই জওয়ানকে ডেকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন তিনি। একটি দুধের প্যাকেট কিনে দেওয়ার আর্জি জানান। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুধ কিনতে চলে যান ইন্দ্র।
কিন্তু তত ক্ষণে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগোতে শুরু করে। পাছে শিশুটি অভুক্ত থাকে, সেই ভেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এক হাতে সার্ভিস বন্দুক এবং অন্য হাতে দুধের প্যাকেট নিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে শুরু করেন ইন্দ্র। শেষমেশ জানলা দিয়ে সাফিয়ার হাতে দুধের প্যাকেটটি পৌঁছে দেন তিনি।
প্ল্যাটফর্মের সিসিটিভি ফুটেজে গোটা ঘটনা ধরা পড়ে। তা সোশ্যাল মিডিয়া প্রকাশ পেতেই ভাইরাল হয়ে যায়। সাফিয়া নিজেও ভিডিয়োটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। ইন্দ্রকে তিনি ‘হিরো’ বলে উল্লেখ করেন। বিষয়টি নজর এড়ায়নি রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের। “চার বছরের শিশুর দুধের জন্য ইন্দ্র যা করলেন, তা নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে,” বলে টুইট করেন তিনি।
উন্নত পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটেন। প্রায় ৩ লক্ষ ব্রিটিশ নাগরিক কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালেই দিন-রাত এক করে দিচ্ছেন সে দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
হাসপাতাল থেকে কোনও ভাবে যদি সংক্রমণ বয়ে আনেন, তার জন্য মাসের পর মাস বাড়িও ফেরেননি অনেকে। এমনই এক স্বাস্থ্য কর্মী সুজি ভন। সামনে থেকে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে বলে দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে পরিবার থেকে দূরে থাকছিলেন তিনি।
বোন শার্লটের কাছে দুই মেয়ে, বছর ন’য়ের বেলা ও বছর সাতের হেটিকে রেখে গিয়েছিলেন তিনি। দীর্গ ন’সপ্তাহ পর সম্প্রতি মেয়েদের কাছে ফেরেন সুজি। বোন শার্লটকে আগে থাকতে সে কথা জানালেও, দুই মেয়েকে সারপ্রাইজ দেবেন ভেবেছিলেন।
সেই মতো দুই মেয়ে যখন সোফায় বসে গল্প করছে, সেইসময় পিছন থেকে এসে দুই মেয়েকে চমকে দেন তিনি। তাতে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে বেলা ও হেটি। মা ফিরে এসেছে, অনেক ক্ষণ তা বিশ্বাসই করতে পারছিল না হেটি। সেই ঘোর কাটতেই মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলে দুই বোনই। দু’হাত দিয়ে তাদের বুকে আঁকড়ে ধরেন সুজিও।
সন্তানের সঙ্গে সুজির এই সাক্ষাৎ রেকর্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন শার্লট। তাঁর টুইটার হ্যান্ডল থেকে ভিডিয়োটি ৬৮ লক্ষ বারদেখা হয়েছে। বহু ভেরিফায়েড এবং আনভেরিফায়েড হ্যান্ডল থেকে সেটি শেয়ারও হয়েছে।