শেখ হাসিনা। —ফাইল চিত্র।
চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃত্ব সরকারের আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পরে সমস্যা সমাধানের যাবতীয় ভার এখন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের উপরে।
হাই কোর্ট সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তটি খারিজ করে দেওয়ার পরে সরকার পক্ষ তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। সেই মামলার শুনানির সময়ে আদালতের বিবেচনার জন্য কোটা সংস্কারের বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারে শেখ হাসিনা সরকার। সূত্রের খবর, সেই প্রস্তাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটা কমানোর কথা থাকতে পারে। ইতিমধ্যে দলের পক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মহম্মদ আলি আরাফত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার নাতি ও ছেলেরা গত পাঁচ বছরে গড়ে ৮ থেকে ১২ শতাংশ কোটা পূরণ করেছেন। আরাফতের কথায়, তাঁরাও পরীক্ষা দিয়ে মেধার ভিত্তিতে কৃতকার্য হওয়ার পরেই কোটায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কোটায় অপূর্ণ পদগুলিতে সাধারণ প্রার্থীদেরই নিযোগ করা হয়েছে। তাঁর এই ব্যাখ্যার পরে ধারণা করা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে ১৫ বা ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিতে চলেছে সরকার।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করছেন, এর পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আর যৌক্তিকতা থাকবে না। ছাত্রেরা রাস্তা ছাড়বেন। দলীয় সূত্রের খবর, রাজনৈতিক কারণেই আগ বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কোপ মারতে চাইছেন না আওয়ামী নেতৃত্ব। তাঁদের ধারণা, এর ফলে আর একটি মহল ‘গেল গেল’ রব তুলতে পারে, যাঁরা আবার তাঁদেরই ভোটব্যাঙ্ক।
তবে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের সর্বত্র পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ এবং তাতে অন্তত ৪০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানির ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিস্থিতির দায় কার?
অনেকেরই বক্তব্য, শাসক দলের পরাক্রম প্রদর্শন ও অহঙ্কারী মনোভাবই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যার জন্য এত মানুষের প্রাণহানি। পুলিশের লাঠি-গুলি-কাঁদানে গ্যাসে জখম অন্তত দু’হাজার মানুষ। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সমন্বয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন ঢাকায় শুরু হয়ে দ্রুত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন চিন সফরে। বিক্ষোভকারীদের সড়ক অবরোধে রোজই জনজীবন যখন বিপর্যস্ত হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আলোচনায় বসেন নিরসনের উপায় খুঁজতে। সূত্রের দাবি, গোড়া থেকেই দলের নেতাদের একাংশ কোটা-বিরোধী আন্দোলনকে বিরোধী দল ‘বিএনপি ও জামাতে ইসলামির ষড়যন্ত্র’
আখ্যা দেন। দলের এক শীর্ষ নেতা বৈঠকে বলেন, পুলিশকে না-নামিয়ে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক সমাধান করতে চান তিনি। কী ভাবে? তাঁর দাওয়াই— শাসক দলের ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ ছাত্র লীগই পথে নেমে শিক্ষা দেবে আন্দোলনকারীদের। তাঁদের কর্মীরাই সড়ক অবরোধ মুক্ত করতে পথে নামবেন।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ঢাকায় ফিরেছেন। সোমবার বিদেশ সফর নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়— মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা কি থাকছে না? উত্তরে হাসিনা বলেন, ‘‘বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে?’’
সোমবার মধ্যরাত থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা দলে দলে বিক্ষোভ মিছিল করে স্লোগান তোলেন, ‘আমি কে, তুমি কে? রাজাকার রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। মঙ্গলবার ঢাকায় প্রথম লাঠি, চাপাতি, উইকেট, ব্যাট এমনকি বন্দুকও নিয়ে ‘রাজনৈতিক সমাধানে’ নামেন ছাত্র লীগের কর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, আন্দোলনকারীরা নিজেদের রাজাকার বলে গর্ব করেছেন, যা স্বাধীনতার চেতনার বি রোধী। অতর্কিত আক্রমণে প্রায় ৩০০ আন্দোলনকারী আহত হন। অভিযোগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া জখম ছাত্রদেরও ওয়ার্ডে ঢুকে মারধর করা হয়।
পর দিন বুধবার দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র সংঘর্ষ। সর্বত্র এ বার ছাত্র লীগকে পাল্টা মার দেন বাকিরা। ছাত্রাবাসগুলি থেকে ছাত্র লীগের নেতানেত্রীদের মেরে বার করে দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় সংগঠনটির সব দফতর। প্রাণহানি হয় ৬ জনের। বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারীদের ডাকা বন্ধ-এ রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসেন সাধারণ মানুষও। শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর। পুলিশের দাবি, জামাতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিলে এই নাশকতা করেছে। সঙ্গে উস্কানি দিয়েছে বিএনপি-ও। শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন— ‘আমরা অরাজনৈতিক। কোটা সংস্কার আমাদের একমাত্র দাবি। কোথাও জ্বালাও-পোড়াও ভাঙচুরকে আমরা সমর্থন করছি না। যারা এই সব করছে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই।’
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনকে ‘আরব স্প্রিং’ ভেবে নিয়ে বিএনপি-জামাত সরকার ওল্টানোর খেলায় নেমে পড়েছিল বলে দাবি বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের। আন্তর্জাতিক মহলে তারা যোগাযোগ শুরু করেছিল বলেও তাঁদের দাবি। এই বার্তা পৌঁছনোর পরেই বৃহস্পতিবার নরম মনোভাব নেয় সরকার। শুক্রবার হিংসা বড় একটা ছড়ায়নি। এখন রবিবার শুরু হওয়া আদালতের শুনানিই ভরসা হাসিনা সরকারের।