একটি চিঠি। তাতে উল্লেখ করা খুনের পরিকল্পনা। এবং তার সঙ্গে একটি সঙ্কেত। প্রতি খুনের আগে এ ভাবেই ‘ধরা দিত’ খুনি। প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত পুলিশকে। কিন্তু আজও সেই খুনির কোনও খোঁজ পায়নি পুলিশ। ষাটের দশকের শেষের দিকে এই খুনির তাণ্ডবে কাঁপত গোটা সান ফ্রান্সিসকো বে অঞ্চল।
জোডিয়াক কিলার। নিজেকে এই নামেই ডাকত খুনি। অন্তত পাঁচটি খুনের কথা নিজেই সংবাদমাধ্যমে খোলা চিঠি লিখে জানিয়েছিল সে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সান ফ্রান্সিসকোর বাসিন্দাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিল একাই। ঘুম উড়িয়েছিল পুলিশেরও।
তার অপরাধের একটি আলাদা ধরন ছিল। এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে খেলার ছলে খুন করত সে। প্রতি বার খুনের আগে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খোলা চিঠি লিখত। সে চিঠিতে নিজের ঠিকানার উল্লেখ থাকত না। তাই পুলিশ কখনও তার ঠিকানা জানতে পারেনি। ওই চিঠিতে পরবর্তী খুনের সঙ্কেত থাকত।
১৯৬৯-এর ১ অগস্ট স্যান ফ্রান্সিসকো এগজামিনার, সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল এবং ভালেজো টাইমস-হেরাল্ড নামে তিনটি আলাদা সংবাদমাধ্যমে চিঠি পাঠায় সে। যাতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় সম্পাদক: লেক হারমানে গত বড়দিনে আমি দু’জন কিশোরীকে খুন করেছি’। তার পর চিঠিতে ওই খুনের বিশদ বিবরণ দেওয়া ছিল। শেষে হুমকি ছিল, যদি তার এই চিঠি প্রথম পাতায় ছাপা না হয় তা হলে আবার কেউ না কেউ খুন হবে। খামের উপরে প্রতিটি চিঠিতেই একটি চিহ্ন (বৃত্তের মধ্যে ক্রস) আঁকা ছিল। চিঠির ভিতরে থাকতে কয়েকটি সাঙ্কেতিক লাইন। খুনির দাবি ছিল, এই সঙ্কেতেই নাকি তার পরিচয় লুকিয়ে।
আলোড়ন পড়ে যায় সান ফ্রান্সিসকো জুড়ে। পুলিশ, এফবিআই যৌথ তদন্ত শুরু করে। এর মধ্যে আরও একটি চিঠি পাঠায় খুনি। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় সম্পাদক: আমি জোডিয়াক বলছি’। তার পর পুরো চিঠি জুড়েই পুলিশ এবং এফবিআই তদন্তকারীদের নিয়ে ব্যঙ্গ ছিল। তাকে ধরতে না পারা নিয়ে ছিল ব্যঙ্গ।
কিছু দিন পর ডোনাল্ড হার্ডেন নামে এক শিক্ষক এবং তাঁর স্ত্রী খবরের কাগজে প্রকাশিত ওই চিঠিতে থাকা সঙ্কেত বহনকারী শব্দগুলোর অর্থ খুঁজে বার করেন। তাঁদের মতে তার অর্থ ছিল, ‘আমি মানুষ মারতে ভালবাসি কারণ এটা খুবই উপভোগ্য। বন্য পশু শিকারের থেকেও এটা অনেক বেশি আনন্দের। কারণ মানুষই সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী।’
১৯৬৯ সালে পল স্টাইন নামে এক ট্যাক্সিচালক খুন হন। জোডিয়াকের দাবি অনুযায়ী, এটা ছিল তার চতুর্থ খুন। ফের খবরের কাগজে চিঠি লিখে খুনের বিবরণ জানিয়েছিল সে। সঙ্গে পলের রক্তমাখা জামাও পাঠিয়েছিল সে। ওই চিঠিতেই আবার হুমকি ছিল, এর পর সে একটি স্কুলবাসের চাকায় গুলি করবে। শিশুরা যখন একে একে রাস্তায় নেমে আসবে তখন তাদের অপহরণ করবে এবং তার পর খুন। প্রতিটি চিঠিতে পুলিশকে ব্যঙ্গ করতে ভুলত না সে।
যে খুনগুলির কথা চিঠিতে নিজে স্বীকার করেছিল, তার মধ্যে প্রথমটি হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। সে দিন ১৭ বছর বয়সি ডেভিড এবং ১৬ বছরের প্রেমিকা বেট্টিকে লেক হারমন রোডে তাঁদের গাড়ির কাছেই গুলি করে খুন করেছিল সে। ১৯৬৯ সালের এক সকালে ভ্যালেজোর একটি প্রত্যন্ত পার্কের কাছে গাড়িতে বসে থাকা ২২ বছরের এক যুবক এবং ১৯ বছরের যুবতীর উপর হামলা চালায় সে। সেই ঘটনায় যুবতী প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। পরে তাঁর থেকে শুনে খুনি জোডিয়াকের স্কেচ আঁকিয়েছিল পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান তদন্তের গতি ফিরিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও জোডিয়াককে ধরতে পারেনি তারা। এর পর ফের ১৯৬৯ সালে সমুদ্রসৈকতে শুয়ে থাকা এক যুগলকে খুন করে সে। ওই বছরই এক ট্যাক্সিচালককেও খুন করে। খুনের পর প্রতি বারের মতো নিজেই পুলিশে ফোন করে খবর দিয়েছিল এবং খবরের কাগজে চিঠিও পাঠিয়েছিল।
১৯৭৪ সালে শেষ বারের মতো এমন চিঠি পেয়েছিল খবরের কাগজগুলো। তার পর আর কোনও চিঠি আসেনি। কিন্তু তদন্ত থেমে থাকেনি। খুনি ধরাও পড়েনি। ২০২০ সালে প্রথম খুনের ৫২ বছর পর খবরের কাগজের চিঠিতে লেখা জোডিয়াকের সঙ্কেত একজন বিশেষজ্ঞ উদ্ধারের দাবি করেন। তাতে নাকি মৃত্যু, স্বর্গ, খুন সংক্রান্ত লেখা ছিল। জোডিয়াক যে মৃত্যুকে ভয় পায় না, ছত্রে ছত্রে সেটাই লেখা ছিল।
জোডিয়াক বেঁচে রয়েছে কি না তা জানা যায় না। আর কোনও চিঠিও আসে না খবরের কাগজের দফতরে। খুনের দাবি করে কেউ পুলিশে ফোনও করে না। তা সত্ত্বেও তদন্ত থেমে নেই। তার স্কেচের সঙ্গে অনেকের মুখের মিলও পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু খুনি ধরা পড়েনি। আজও রহস্য সমাধানের চেষ্টা করে চলেছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু জোডিয়াক রহস্য হয়েই রয়ে গিয়েছে।
এই ঘটনার অনুপ্রেরণায় একাধিক ছবি হয়েছে। ২০১৭ সালে ‘হান্ট ফর দ্য জোডিয়াক কিলার’ নামে একটি টিভি সিরিজও হয়েছিল।