বালির বাড়িতে মায়ের সঙ্গে সঞ্চয়িতা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
রাত সাড়ে ১১টা। প্রথম কানে এসেছিল সাইরেনের শব্দ। হস্টেলের জানালা দিয়ে দেখলাম, পড়িমড়ি করে দৌড়চ্ছেন ইউক্রেনের বাসিন্দারা। কলেজের অ্যানাটমি বিল্ডিংয়ের নিচে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে যাওয়ার মুহূর্তে আমাদেরও মনে হয়েছিল, ‘আর হয়তো বেঁচে ফিরব না!’ কত দিন, কতক্ষণ ওই বাঙ্কারে থাকতে হবে জানা ছিল না। তাই ফ্রিজ থেকে চকোলেট হাতে নিয়ে ছুটেছিলাম তিন বন্ধু। রাত সাড়ে ৩টের সময়ে ফিরে এলাম হস্টেলের ঘরে। কিন্তু চারদিকে তখন কেমন যেমন একটা অনিশ্চয়তার পরিবেশ।
তিন বন্ধু মিলে স্থির করলাম, ট্যাক্সি ভাড়া করেই পাড়ি দেব রোমানিয়া সীমান্তে। ২৬ ফেব্রুয়ারি এক ট্যাক্সিচালককে বললাম, পরের দিন সকালে চলে আসতে। সাড়ে তিন হাজার ইউক্রেনের মুদ্রায় ভাড়া চাইলেন, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার টাকা! ভাড়া বেশি হলেও আর চিন্তা করলাম না। সীমান্তে পৌঁছতেই হবে। তবে সংশয় ছিলই, ট্যাক্সিচালক আদৌ আসবেন তো! তবে পরদিন ভোর সাড়ে ৬টায় তিনি আসতেই তিন বন্ধু উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। যেতে হবে প্রায় ৬০ কিলোমিটার রাস্তা। কিছুক্ষণ চলার পরে একটি পেট্রল পাম্পে থামল ট্যাক্সি। তিন জন চোখে-মুখে জল দিতে আর শুকনো খাবার কিনতে নেমেছিলাম। আচমকাই বেজে উঠল সাইরেন। দৌড়ে এসে ট্যাক্সিচালক বললেন, “জলদি গাড়িতে উঠুন। এক মুহূর্ত আর বাইরে থাকা যাবে না।” কোনওমতে উঠতেই তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করল ট্যাক্সি। আচমকা অনেকটা দূরে বিস্ফোরণের শব্দ। কালো ধোঁয়ায় আকাশ ঢাকল।
বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরত্ব যাওয়ার পরে হঠাৎ থমকে গেল ট্যাক্সি। সামনে অগণিত গাড়ির লাইন। বোঝা গেল, আর এগোনো সম্ভব নয়। তিন জনে নেমে পড়ে হাঁটা শুরু করলাম। ব্যাগে শুকনো খাবার, জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে পাঁচ লিটারের জলের ব্যারেল ভরা রয়েছে। হাতে আরও ৫ লিটারের জলের ব্যারেল। সেই সব টানতে টানতেই চড়াই-উতরাই পথ ভেঙে এগোতে লাগলাম। রাস্তার চারদিকে তখন পড়ে রয়েছে জলের ব্যারেল, জামাকাপড়। বুঝলাম, অনেকেই হাঁটার পথে আর ভার বইতে পারেননি। একটা সময়ে আমরাও আস্তে আস্তে ভার কমাতে শুরু করলাম। কারণ কখনও হাঁটছি, কখনও প্রায় দৌড়চ্ছি। প্রায় দেড় ঘণ্টার সেই হাঁটাপথে ইউক্রেনের বাসিন্দারা জল, খাবার এগিয়ে দিয়ে যে ভাবে পাশে থেকেছেন, তা কোনও দিন ভোলার নয়। শেষে দুপুর ২টো নাগাদ পৌঁছলাম রোমানিয়া সীমান্তে।
সেখানে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। প্রায় তিন-চার হাজার মানুষের ভিড়। চোখের সামনে দু’-এক জনকে ভিড়ের চাপে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে দেখলাম। বলা হল, ছেলে ও মেয়েদের আলাদা আলাদা লাইনে দাঁড়াতে হবে। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ কোনওমতে সীমান্ত পার করতে পারলাম। রোমানিয়ার লোকজনও খাবার-জল ও ওষুধপত্র এগিয়ে দিলেন হাতের কাছে।
ও পারে গিয়ে দেখলাম, মাত্র চারটি বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম বাসে তো আমাদের জায়গাই হল না। শেষে অসুস্থতার কথা বলে কোনও মতে দ্বিতীয় বাসে উঠে পড়লাম। রাত ৮টা নাগাদ ৫০ জনকে নিয়ে সেই বাস ছাড়ল। গিয়ে পৌঁছলাম বুখারেস্টের একটি আশ্রয় শিবিরে। রোমানিয়ার সিম কার্ড দেওয়া হয়েছিল আমাদের। তা দিয়েই বাড়িতে ফোন করছিলাম। কিন্তু মোবাইলের চার্জ যাতে শেষ না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ সেখানেই কাটল। খবর পেলাম, আমাদের পরে যাঁরা সীমান্ত পার করেছেন, তাঁদের সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুরু হল আমাদের প্রতিবাদ। “খাবার চাই না। বাড়ি ফিরতে চাই”, নিরুপায় হয়ে বলেছিলাম ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের।
বুধবার ফের বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য বিমানবন্দর। সেখানে এজেন্টরা তালিকার নাম ধরে ধরে বিমানে তুলছিলেন। আমরা প্রতিবাদ করে সেই তালিকা ছিঁড়ে ফেললাম। তার পরে বিমানে উঠে রাত দেড়টা নাগাদ পৌঁছলাম দিল্লিতে। পশ্চিমবঙ্গের ডেপুটি রেসিডেন্ট কমিশনার বঙ্গ ভবনে নিয়ে যান। দেখা করতেও আসেন। তাঁকে বলেছিলাম, যে ভাবে হোক কলকাতার প্রথম উড়ানে টিকিট করে দিন। শেষে আজ, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পৌঁছলাম কলকাতা বিমানবন্দরের। বাইরে মা-বাবা, মামাকে দেখে সব ক্লান্তি কেটে গেল। পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরব ইউক্রেনের মাটিতে। তার আগে পুরী যাব।
অনুলিখন: শান্তনু ঘোষ
(টার্নোপিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী)