এই সীমান্ত অতিক্রম করতে পারলে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ পেরিয়ে পৌঁছতে হবে ছ’কিলোমিটার দূরের পোল্যান্ড সীমান্তে। সে দেশে ঢুকলে পোল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরাই দেশের বিমানে ওঠার ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে আদৌ আজ সীমান্ত পেরোতে পারব কি না, এখনও জানি না। চূড়ান্ত অসহায় লাগছে।
ইউক্রেন থেকে ভারতীয় পড়ুয়াদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে জমায়েত। বৃহস্পতিবার, মৌলালিতে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে চার ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কিন্তু আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই নেই ইউক্রেনীয় সেনার। কাগজও দেখছে না, যেতেও দিচ্ছে না। এ দিকে শূন্যের নীচে নামছে তাপমাত্রা। এ ভাবে সারা রাত সীমান্তে অপেক্ষা করতে হলে বাঁচব কি না জানি না।
গতকাল ভোরে সহপাঠিনীর ঠেলায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিলাম। ও জানাল, তখনই বেরোতে হবে। ভারতীয় দূতাবাস থেকে নির্দেশ এসেছে, দ্রুত খারকিভ ছাড়তে হবে। প্রয়োজনে হেঁটেই পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। যেন তেন প্রকারেণ খারকিভ ছেড়ে যেতে হবে। রাশিয়া আরও ভয়ঙ্কর আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে।
খারকিভের বাঙ্কারে বসে বোঝার উপায় নেই, বাইরে দিনের আলো ফুটেছে কি না। তবু এর পরে আর সময় নষ্ট করিনি। ছ’দিন বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকার পরে বাড়ি ফিরতে পারব— এটা ভেবেই যেন মুক্তির আনন্দ পাচ্ছিলাম। হাওড়ার ইছাপুরের বাড়িতে ফোন করে সে কথা জানাতেই বাবা (নন্দলাল দাস) বললেন, বড় ব্যাগ বাদ দিয়ে শুধু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে। কারণ, নিকটবর্তী স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে না পারলে দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হতে পারে। ভারী ব্যাগপত্তর নিয়ে হাঁটা কি মুখের কথা না কি! কিন্তু প্রাণ হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরার সেই সফর যে এতটা বিভীষিকাময় ও কষ্টসাধ্য হবে, তা ভাবিনি।
বুধবার সকাল তখন সাড়ে ৬টা (স্থানীয় সময়)। খারকিভ ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে আমরা ২০০ জন পড়ুয়ার একটি দল স্থানীয় রেলস্টেশনের দিকে রওনা হলাম। দেখি, চার দিকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। সাজানো-গোছানো শহরটা যেন রাতারাতি শ্মশান! সে সময়ে অবশ্য বোমাবর্ষণ হচ্ছিল না। চার দিকে পোড়া জিনিস ও বারুদের গন্ধ। মাথার উপর দিয়ে মাঝেমধ্যে উড়ে যাচ্ছে ফাইটার জেট। কিছুটা হাঁটার পরে শুনলাম, সামনের স্টেশনে হাজার হাজার যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায়। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, তার পরের স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে ট্রেনে উঠব। পরের স্টেশন প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। এতটা? মনের জোর আর বাড়ির টানের কাছে হার মানল ক্লান্তিও। হাঁটতে হাঁটতে সকাল ১১টা নাগাদ পৌঁছলাম স্টেশনে।
দেখি, সেখানেও থিকথিক করছে ভিড়। অধিকাংশই ইউক্রেনীয়। কয়েক দিন ধরেই শুনছিলাম, ইউক্রেনের সেনা বা এদেশীয়রা ভারতীয়দের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছে না। ট্রেনে আগে ওঁদের ওঠানো হচ্ছে, পরে ভারতীয়দের। বেশি ভিড় হলে ভারতীয়দের উপরে লাঠিচার্জ করে ট্রেন-বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হল। ট্রেন আসতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এর পরে আমাদের ২০০ জনের মধ্যে ট্রেনে উঠতে পারলাম মাত্র ২০ জন। সকলেই মেয়ে। ভারতীয় পুরুষ পড়ুয়াদের ট্রেনে উঠতেই দেওয়া হল না! দু’দিন আগে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আমাদের কলেজের পাশের হস্টেলের নবীন শেখরাপ্পার মৃত্যুর খবর আমরা কেউই মেনে নিতে পারিনি। এ দিন সহপাঠীরা ট্রেনে উঠতে না পারায় মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পরে বুঝতে পারলাম, জলের বোতলটা রয়ে গিয়েছে রুমমেটের কাছেই। কামরায় থাকা কলেজের ২০ জন ছাত্রীর এর-ওর থেকে চেয়ে প্রথমে জল খাচ্ছিলাম। এক সময়ে সকলেরই জল শেষ হয়ে এল। দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার হেঁটে আসা, তার পরে ট্রেনেও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। অগত্যা তেষ্টা মেটাতে ট্রেনের শৌচাগারের জল খেতে হল। আগের রাতে খাবার জোটেনি, খিদেয় পেট জ্বলছিল।
পথে ভিনিতশা স্টেশনে ট্রেন থামতে কয়েকটি খাবারে প্যাকেট ও জলের বোতল দিয়ে গেলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা। ভাগাভাগি করে সেই খাবার-জল খেয়েই যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। তার পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। ঘুম ভাঙল আজ সকালে, বেলার দিকে। ট্রেন তখন ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে। দুপুর দেড়টা নাগাদ লিভিভ পৌঁছল ট্রেন। জানতে পারলাম, ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরা আমাদের বাসে করে সীমান্তে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু কোথায় কী! শেষে নিজেরাই গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম সীমান্তের দিকে।
সন্ধ্যা নামার আগেই সীমান্তে পৌঁছে দিয়েছিলাম। দেখি, পোল্যান্ডে ঢোকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে কাতারে কাতারে মানুষ। ইউক্রেনীয় সেনারা চরম অসহযোগিতা করছেন। এক-এক জনের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছেন। কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকলে তা ছিঁড়ে ফেলেও দিচ্ছেন। আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখছেন না। আমার মোবাইলের চার্জও শেষ। বান্ধবীর ফোন থেকে বাড়িতে সেই খবরটুকু দিতে পেরেছি।
এই সীমান্ত অতিক্রম করতে পারলে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ পেরিয়ে পৌঁছতে হবে ছ’কিলোমিটার দূরের পোল্যান্ড সীমান্তে। সে দেশে ঢুকলে পোল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরাই দেশের বিমানে ওঠার ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে আদৌ আজ সীমান্ত পেরোতে পারব কি না, এখনও জানি না। চূড়ান্ত অসহায় লাগছে।
অনুলিখন: দেবাশিস দাশ
(লেখক খারকিভ ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী)