আসছে নতুন অতিথি। সেই উপলক্ষে আর্চিকে কোলে নিয়ে হ্যারি-মেগানের ফোটোশুট। ছবি ইনস্টাগ্রাম।
আঙুল তুলেছেন রাজপরিবারের প্রাক্তন দুই সদস্য। এনেছেন বর্ণবৈষম্যের গুরুতর অভিযোগ। এই অবস্থায় নীরবতা ভাঙতে দেরি করলেন না রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বললেন, ‘‘হ্যারি ও মেগান মার্কলের শেষ কয়েকটা বছর কতটা কঠিন ছিল, তা জেনে গোটা পরিবার বিষণ্ণ। যে প্রসঙ্গগুলি তোলা হয়েছে, বিশেষ করে বর্ণবৈষম্যের, তা উদ্বেগজনক। এক-এক জনের স্মৃতির মধ্যে ফারাক হতে পারে, তবে এটা খুবই গুরুতর বিষয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। পরিবার বিষয়টি দেখবে। এবং পারিবারিক গোপনীয়তা বজায় রেখে তা করা হবে। হ্যারি, মেগান ও আর্চি পরিবারের খুবই প্রিয় সদস্য হয়ে থাকবে বরাবর।’’
সোমবার রাতে ওপরা উইনফ্রের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে গোটা দুনিয়া স্তম্ভিত হয়ে শুনেছে হ্যারি আর মেগানের কথা। বর্ণবৈষম্য থেকে শুরু করে মেগানের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা, অপমান, তাঁকে চোখের জলে হেনস্থা করার মতো একের পর এক অভিযোগে ব্রিটেনের রাজপরিবারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন তাঁরা। এক কোটিরও বেশি ব্রিটেনবাসী টিভির পর্দায় তার সাক্ষী। সেই সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে কার্যত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে দেশবাসী। এক দল রাজপরিবারের সমর্থক এবং অন্যেরা বিপক্ষে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে জোর চর্চা। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে লেবার পার্টির নেতা কেয়ার স্টারমার বাকিংহামের কাছে তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মুখপাত্র জানিয়েছেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সাহস যে-ই দেখান না-কেন, তাঁর প্রশংসা করেছেন প্রেসিডেন্ট। ঘরের মেয়ে মেগানের পাশে দাঁড়িয়েছেন হিলারি ক্লিন্টনও।
শ্বশুর-শাশুড়ি, দুই ছেলে, পুত্রবধূর সাধারণ যৌথ পরিবারে এই ধরনের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ হয়তো নতুন নয়। তা বলে ব্রিটিশ রাজপরিবারেও একই ঘটনা? প্রশ্ন, ব্রিটেনবাসীর ভালবাসার রাজপ্রাসাদে সত্যিই কি এ সব ঘটেছিল? নাকি মেগানের সব অভিযোগ মিথ্যে? মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই উত্তর জানাতে চাপ বাড়ছিল রাজপরিবারের উপরে। রাতেই এল রানির বিবৃতি।
সন্দেহ নেই মেগান-হ্যারির সাক্ষাৎকার বাকিংহামের পোক্ত প্রাচীরে জোর ধাক্কা দিয়েছে। রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, আজ দফায় দফায় জরুরি বৈঠকে বসেন যুবরাজ চার্লস, রাজপুত্র উইলিয়াম ও রাজপরিবারের অন্যান্য বর্ষীয়ান সদস্যেরা। একটি ব্রিটিশ সংবাদপত্রেের দাবি, ‘গত ৮৮ বছরে সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে রাজপরিবার।’ আর একটিতে শিরোনাম, ‘উইনসরের যুদ্ধ’।
বাবা শ্বেতাঙ্গ হলেও কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের কন্যা মেগান। তিনিই ব্রিটেনের রাজপরিবারে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ সদস্য। মেগান মনে করেন, শুধুমাত্র এই কারণে তাঁদের ছেলে আর্চিকে রাজপুত্রের খেতাব দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি পুলিশি নিরাপত্তাও। আর্চির জন্মের আগে রাজবাড়ির অন্দরমহলে নাকি মেগানের হবু সন্তানের গায়ের রঙ নিয়ে জোর চর্চা চলত। মেগানের সামনেই বলা হত, কতটা কালো হতে পারে তাঁর সন্তানের গায়ের রঙ। অনুষ্ঠানের শেষে ওপরাকে হ্যারি জানান, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ আর্চিকে নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। রানির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ভালই।
তাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চা শুরু হয়েছে, নিশ্চয়ই প্রিন্স চার্লস আর উইলিয়াম রয়েছেন এর নেপথ্যে। সেই সন্দেহ আরও পোক্ত হয়েছে হ্যারির স্বীকারোক্তিতে। হ্যারি আগেই বলেছিলেন, রাজপরিবারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পরে, তাঁর বাবা যুবরাজ চার্লস ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন না। ফোনও ধরতেন না। হ্যারিদের খরচপাতিতে কোপ পড়েছিল। এক রকম বাধ্য হয়ে নেটফ্লিক্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন হ্যারি।
রাজবাড়িতে ‘দমবন্ধ করা’ দিনগুলোর বিষয়ে মেগান বলেছিলেন, এক এক সময়ে তাঁর মনে হত, বেঁচে থাকা অর্থহীন। মৃত্যুর কথা প্রায়ই মাথায় ঘুরত। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মেগান যখন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন, তখন বারবার চিকিৎসার জন্য আর্জি জানিয়েও রাজবাড়ির সাড়া মেলেনি। প্রশ্ন উঠছে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জনসমক্ষে সরব হওয়া উইলিয়াম এবং তাঁর স্ত্রী কেট কেন মেগানের পাশে দাঁড়াননি।
রাজবাড়িতে মেগান আসার পরে প্রচারের পুরো আলো গিয়ে পড়েছিল ছোট বৌয়ের উপরে। বড় বৌ কেট কখনও রাজপরিবারের নিয়মের বিরুদ্ধে যাননি। কোনও বিতর্কে জড়াননি। অন্য দিকে আমেরিকান, কৃষ্ণাঙ্গ মেগান শুরু থেকেই স্পষ্টবক্তা। অনেকেই তাঁর মধ্যে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা যুবরানি ডায়ানার ছায়া দেখেছিলেন। জনপ্রিয়তার নিরিখে হ্যারি-মেগান প্রথম থেকেই পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন রাজপরিবারের বাকি সদস্যদের। তার মূল্য চোকাতে হয়েছে ওঁদের। রাজবাড়ির অন্দরে মেগানদের কাঁটা বাড়ছিল। আর বাইরের বাতাস একটু একটু করে বিষিয়ে দিচ্ছিল মিডিয়ার একাংশ। প্রতি পদে বড় বৌ কেটের সঙ্গে তুলনা করা হত মেগানকে। মেগানের সব কিছু যেন খারাপ। জিন্স আর শার্ট পরে উইম্বলডনে গেলে বলা হল, মেগান ঠিক মতো পোশাক পরতেই জানেন না। ছেলে আর্চিকে প্রচারের আড়ালে রাখতে চাইলে মিডিয়ায় বলা হয়, ব্রিটেনের করদাতাদের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। ঘরে-বাইরে তুমুল চাপ সামলাতে না-পেরেই রাজবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হ্যারি-মেগান। ক্যালিফর্নিয়ার নিভৃত বাড়িতে এখন দ্বিতীয় সন্তানের আসার দিন গুনছেন তাঁরা। আজই মেগানের মাতৃত্বকালীন ফোটোশুটের একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছেন তাঁদের চিত্রগ্রাহক।
খোদ রানি নিজে বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেওয়ার আগে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রায় অর্ধেক ব্রিটেনবাসী ওই সাক্ষাৎকার পছন্দ করেননি। ভারতীয় অভিনেত্রী সিমি গারেওয়াল টুইট করেছেন, ‘মেগানের কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করি না। নিজেকে নির্যাতিতা হিসেবে তুলে ধরতে, সহানুভূতি আদায় করতে মিথ্যে বলছেন। শয়তান একটা।’ যদিও পরের টুইটে বলেন, শয়তান বলাটা একটু বাড়াবাড়ি ছিল।
মেগানের বাবা টমাস মার্কলও মনে করেন, ব্রিটিশ রাজপরিবারে বর্ণবিদ্বেষ থাকতে পারে না। বরং মেয়ের কথার সত্যতা যাচাইয়ের দাবি তুলেছেন তিনি। মেগান-ভক্তদের মতে, বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক বহু দিন ধরেই তিক্ত। তার জেরেই টমাসের এই মন্তব্য।