পাকিস্তানে সাম্প্রতিক জঙ্গি হানার ঘটনায় অন্তত ৯ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। জঙ্গি এবং পুলিশ উভয় পক্ষেই ঘটেছে প্রাণহানি। জঙ্গি হানার পর প্রকাশ্যে এসেছে বিধ্বস্ত সেই থানার ছবি।
করাচির শরিয়া ফয়জালে শীর্ষ পুলিশ কর্তার দফতরে শুক্রবার রাতে হানা দেয় এক দল জঙ্গি। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিট নাগাদ ৮-১০ জনের একটি সশস্ত্র দল আচমকা করাচির ওই পুলিশঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে।
পুলিশকর্মীদের লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করেন জঙ্গিরা। সেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় পাঁচ তলা ওই পুলিশ ভবনটির দেওয়াল। জঙ্গিদের গুলির পাল্টা দেন পুলিশকর্মীরাও। করাচির এই জঙ্গি হানার দায় স্বীকার করে নিয়েছে তেহরিক-ই-তালিবান গোষ্ঠী।
পুলিশ কর্তা ইরফান বালোচ জানিয়েছেন, দু’জন জঙ্গি পুলিশের উর্দি পরে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন। কয়েক জন ঢুকেছিলেন পিছনের দরজা দিয়ে। পুলিশের ওই কার্যালয়ের একটি তলা খালি করে ফেলেছিলেন জঙ্গিরা।
থানার ভিতর টানা প্রায় ৪ ঘণ্টা পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গুলির লড়াই চলে। রাত ১০টা ৫০ মিনিট নাগাদ ভবনটিকে জঙ্গিদের দখলমুক্ত করতে পেরেছে পাক পুলিশ। এর পর ঘটনাস্থলের ছবিগুলি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে।
ছবিতে দেখা গিয়েছে, পুলিশকর্তার দফতরের দেওয়ালে বুলেটের দাগ। গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে গোটা ভবন। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সিঁড়ির দেওয়াল। অফি ঘরের দেওয়ালের কাচও ভেঙে পড়েছে।
বুলেটের আঘাতে দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। সিঁড়িময় ছড়িয়ে রয়েছে দেওয়ালের ভাঙা অংশ। সংঘর্ষের পর সিলিং থেকেও খসে পড়েছে পাথরের চাঁই। ধ্বংসস্তূপের মাঝে পা ফেলার জায়গা নেই।
জঙ্গি হানার পর করাচির শীর্ষ পুলিশকর্তার দফতরের এই ক্ষতবিক্ষত ছবিগুলিতে যেন প্রতিফলিত হয়েছে সাম্প্রতিক পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতিই। দেশের রাজনীতিতে স্থিতাবস্থার অভাব প্রকট হয়েছে বার বার। অর্থনীতিও বিধ্বস্ত।
শনিবারই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তথা পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) নেতা খাজা আসিফ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দেশ দেউলিয়া। গলা পর্যন্ত দেনার দায়ে ডুবে রয়েছে সরকার। আর্থিক সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বরাবরের অভিযোগ, দেশটি জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়। সরকারের মদতেই পাকিস্তান জঙ্গিদের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে বলে দাবি করেন কেউ কেউ। আন্তর্জাতিক স্তরেও জঙ্গি প্রসঙ্গে বার বার সমালোচিত হয়েছে এই দেশ।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাঝে সেই জঙ্গি হানাই ঘুম উড়িয়েছে পাক প্রশাসনের। জানুয়ারি মাসেই পেশোয়ারের একটি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫৯ জনের। উল্লেখ্য, সে ক্ষেত্রেও জঙ্গিদের নিশানায় ছিলেন পুলিশকর্মীরা।
পরিসংখ্যান বলছে, সামরিক ক্ষেত্রে পাক সরকারের ব্যয় তুলনামূলক বেশি। সামাজিক উন্নয়নের চেয়েও সামরিক খাতে বেশি ব্যয় করে এই দেশ। তা সত্ত্বেও দেশের পুলিশ এবং নিরাপত্তারক্ষীদের বার বার জঙ্গি হানার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
পাকিস্তানে এই মুহূর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জনগণের সাধ্যের মাত্রা ছাড়িয়েছে। দেশে এক লিটার দুধের দাম ২৫০ টাকা। এক সময় প্রতি দিন খাবারের পাতে যা থাকত, সেই মুরগির দামও সাধ্যের বাইরে। এক কেজি মুরগির মাংসের দাম ৭৮০ টাকা। আটা, ময়দা নিয়ে জনগণের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যাচ্ছে হামেশাই।
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক তহবিল আইএমএফ থেকে ৬০০ কোটি ডলার অনুদান (বেলআউট) পেয়েছিল পাকিস্তান। ২০২২ সালে ভয়াবহ বন্যার পর আরও ১১০ কোটি ডলার অনুদান পায় ইসলামাবাদ।
কিন্তু নভেম্বরে সেই অনুদান দেওয়া বন্ধ করে দেয় আইএমএফ। আঙুল তোলা হয় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপান-উতোরের দিকে। পাশাপাশি, রাজস্বের ঘাটতি নিয়েও ক্ষোভপ্রকাশ করেছে আইএমএফ।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় তলানিতে, সাধারণ মানুষের মাথায় হাত— অর্থনীতি যেন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে করাচির ওই পুলিশ দফতরের মতোই। জীর্ণ ভবনটিতে জঙ্গিদের গুলিতে যেমন খসে পড়েছে পলেস্তারা, তেমন পাক অর্থনীতিতেও যেন একে একে ভেঙে পড়ছে বুনিয়াদি স্তম্ভ। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে বিশেষজ্ঞেরা।