Pervez Musharraf Death

কার্গিল যুদ্ধ থেকে আগরা চুক্তি, মুশারফের জমানায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উত্থানপতন

২০০১ সালের জুলাইয়ে আগরায় বসে কাশ্মীর নিয়ে চুক্তিতে শুধু সই করার অপেক্ষা ছিল। তার কয়েক মুহূর্ত আগেই ভেস্তে যায় সেই চুক্তি সই। দায়ী ছিলেন কি পারভেজ মুশারফ?

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৩৯
Share:

২০০১ সালে সই করার কিছু আগে ভেস্তে গিয়েছিল আগরা চুক্তি। — ফাইল ছবি।

স্থানীয় নেতারা বার বার দাবি করে গিয়েছেন, কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলা হোক। অতীতে সেই চেষ্টা যে হয়নি, তা কিন্তু একেবারেই নয়। ২০০১ সালের জুলাইয়ে আগরায় টেবিলে বসে কাশ্মীর নিয়ে চুক্তিতে শুধু সই করার অপেক্ষা ছিল। তার কয়েক মুহূর্ত আগেই ভেস্তে যায় সেই চুক্তি সই। মনে করা হয়, এ জন্য অনেকাংশেই দায়ী পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশারফ। কার্গিল যুদ্ধের কারণে আগরা চুক্তির টেবিলে বসার আগেই ভারতের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তাঁর কারণেই বার বার ওঠানামা করেছে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের গ্রাফ।

Advertisement

১৯৯৯ সালের মে থেকে জুলাই কার্গিল যুদ্ধ শহিদ হয়েছিলেন প্রায় ৫০০ জন ভারতীয় জওয়ান। অথচ সেই বছরের শুরুতেই দুই দেশের সম্পর্ক ভিন্ন এক মাত্রায় পৌঁছেছিল। দিল্লি থেকে লাহোর পর্যন্ত ‘সদা-এ-সরহদ’ বাস পরিষেবা চালু হয়েছিল। ওয়াঘা-আট্টারি সীমান্ত দিয়ে চলাচল করত সেই বাস। কার্গিল যুদ্ধের সময়েও চালু ছিল বাস পরিষেবা। ওই বাসে চেপে লাহোর গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে শান্তির সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা। সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নওয়াজ শরিফ। লাহোরে দাঁড়িয়ে অটল বলেছিলেন, ‘‘আমি যুদ্ধ হতে দেব না। তিন বার লড়েছি। খুব দামি ছিল সেই সওদা। আমি আর যুদ্ধ হতে দেব না।’’ তখনও অটল জানতেন না, আর কয়েক মাস পর আরও এক যুদ্ধ লড়বে দুই প্রতিবেশী দেশ।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দাবি, তৎকালীন পাক সেনাপ্রধান নওয়াজ শরিফের উচ্চাশার কারণেই দুই দেশের সৌহার্দ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নিজেদের ক্ষমতা না মেপেই কার্গিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুশারফ। আর সে জন্য মুখ পুড়েছিল পাকিস্তানের। পাকিস্তানের একটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকেও কার্গিল আক্রমণের রূপরেখা দেখিয়েছিলেন তিনি। বেনজির খারিজ করে দেন সেই পরিকল্পনা। কিন্তু নওয়াজের ক্ষেত্রে আর সে রকম হয়নি।

Advertisement

কার্গিল যুদ্ধের কারণে আগরা চুক্তির টেবিলে বসার আগেই ভারতের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন মুশারফ! —ফাইল ছবি।

১৯৯৯ সালের মে থেকে জুলাই জম্মু এবং কাশ্মীরের দ্রাস-কার্গিল সেক্টরে চলে লড়াই। পাকিস্তানের দিক থেকে নাগাড়ে অনুপ্রবেশ চলতে থাকে কার্গিলে। পাকিস্তান প্রথমে দাবি করেছিল, জঙ্গিরাই এ সব করছে। পরে যদিও নিজের আত্মজীবনী ‘ইন দ্য লাইফ অব ফায়ার’-এ মুশারফ স্বীকার করেছিলেন, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে ছিল পাক সেনাও। মনে করা হয়, মুশারফ ভেবেছিলেন দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ যুদ্ধ করছে দেখে হস্তক্ষেপ করবে আমেরিকা-সহ আন্তর্জাতিক মহল। তাতে লাভের ধন আসবে পাকিস্তানেরই ঘরে। কাশ্মীরের ভূখণ্ড চলে আসবে তাদের দখলে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলকে কিছু করতে হয়নি। তার আগেই পাক সেনাবাহিনীকে শায়েস্তা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই বিজয় ঘোষণা করে ভারত। বহু বছর পর নওয়াজের প্রাক্তন সহকারী দাবি করেছিলেন, তাঁর আমলে ভারতের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠছিল, তা ভেস্তে দিতেই কার্গিলে যুদ্ধ বাধিয়েছিলেন মুশারফ। ওই বছরই অক্টোবরে নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন মুশারফ। নওয়াজের সহকারী রশিদ যদিও মনে করেন, নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করার থেকেও মুশারফ বেশি ‘অপরাধ’ করেছেন কাশ্মীরিদের যন্ত্রণা দিয়ে। তাঁর জন্যই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি।

১৯৯৯ সালের অক্টোবরে নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন মুশারফ। — ফাইল ছবি।

কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের জন্য ২০০১ সালের জুলাই মাসে সস্ত্রীক আগরা এসেছিলেন মুশারফ। তখন তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। কাশ্মীর সমস্যার জন্য চার পয়েন্টের একটি সমাধান তৈরি করেছিলেন তিনি। কী ছিল সেই সমাধান সূত্র? এক, নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) থেকে দুই দেশের ক্রমে সেনা সরাবে। দুই, কাশ্মীর সীমান্তে কোনও রদবদল হবে না। তবে কাশ্মীরের মানুষ নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ইচ্ছামতো যাতায়াত করতে পারবেন। তিন, কাশ্মীরকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। বাজপেয়ী এটি নিয়ে খুব বেশি আপত্তি করেননি। চার, জম্মু ও কাশ্মীরে নজর রাখবে ভারত, পাকিস্তান এবং স্থানীয় কাশ্মিরী নেতৃত্ব।

আগরায় এসে সস্ত্রীক তাজমহল দর্শনে গিয়েছিলেন মুশারফ। — ফাইল ছবি।

শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি ভেস্তে যায়। ২০০৪ সালে একটি সাক্ষাৎকারে আগরা চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার জন্য ভারতকেই দায়ী করেন মুশারফ। তিনি বলেন, ‘‘আমায় বলা হয়েছিল, ভারতীয় মন্ত্রিসভা এই চুক্তিতে সায় দেয়নি।’’ অন্য একটি সূত্র দাবি করে, এই চুক্তি সইয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং)-এর প্রাক্তন প্রধান এএস দুলাত ২০১৫ সালে দাবি করেছিলেন, তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর জন্যই আগরায় চুক্তি সই হয়নি। মুশারফের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন আডবাণী। সেখানে দাউদের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তাতেই নাকি অন্য পথে বয়েছিল স্রোত।

তবে রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ মনে করে, বাজপেয়ীই আর বিশ্বাস করতে পারেননি মুশারফকে। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে গিয়ে শান্তির কথা বলেছিলেন। তিন মাসও কেটেছিল না। কার্গিল দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করে মুশারফের নেতৃত্বাধীন পাক সেনা। সেই মুশারফ আর নাকি আস্থা রাখতে চাননি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। অগত্যা খালি হাতে ইসলামাবাদ ফিরতে হয়েছিল মুশারফকে। পাকিস্তানে গিয়ে মুখ পুড়েছিল তাঁর। দেশে আর্থিক সংস্কারের জন্য অনেক নীতি এনেছিলেন মুশারফ। সে জন্য প্রশংসাও পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সৌহার্দ্য গড়ে তোলার কৃতিত্ব অধরাই থেকে গিয়েছে প্রাক্তন সেনাপ্রধানের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement