Libya Flood

শহরের একাংশ নিশ্চিহ্ন, বদলে গিয়েছে মানচিত্রই! লিবিয়ার বন্দরনগরে লাশের পাহাড়, হাজার হাজার মৃত

রাজনীতি, সন্ত্রাস-সহ নানা সমস্যায় জর্জরিত লিবিয়া দেশটায় যে গুটিকতক ধনী শহর আছে, তার মধ্যে অন্যতম ডারনা। অন্তত রবিবারের আগে পর্যন্ত তা-ই ছিল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:২৮
Share:

বন্যার আগে এবং পরে লিবিয়ার বন্দর শহর ডারনা। ছবি: রয়টার্স।

লাশের পর লাশ জমেছে লিবিয়ার ডারনায়। যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন, তাঁরা যে দিকে তাকাচ্ছেন এই একই দৃশ্য দেখছেন। শহরের জমা জল, কাদার স্রোত, সমুদ্রের জল, ধসে যাওয়া বাড়ির ছাদে-জানলায়— সর্বত্র মৃতদেহের ছড়াছড়ি। শহরটায় যেন আর কিছু নেই। পাহাড়ছোঁয়া ঢালু জমিতে গড়ে ওঠা শহর ডারনা। তার এক প্রান্তে ভূমধ্যসাগর। তবে ডারনাকে আপাতত মৃত্যু উপত্যকা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাচ্ছে না। গত তিন দিনে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৫৩০০ ছাড়িয়েছে। লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত বন্যায় নিখোঁজ ১০ হাজারের বেশি মানুষ। ফলে আশঙ্কা, মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে।

Advertisement

রাজনীতি, সন্ত্রাস-সহ নানা সমস্যায় জর্জরিত লিবিয়া দেশটিতে যে গুটিকতক ধনী শহর রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ডারনা। অন্তত রবিবারের আগে পর্যন্ত তা-ই ছিল। সাজানো-গোছানো এই বন্দর শহরে রাজনৈতিক উথালপাথাল ছিল কম। নীল সাগরের গর্জনই বেশি। শহরকে বেড় দিয়ে যে সড়কটি এগিয়েছে, তারই গা ছুঁয়ে আছে সমুদ্র। উল্টো দিকে একের পর এক মাথা তুলেছে ইমারত। কিন্তু রবিবারের পর সেই রাস্তা, উঁচু ইমারতগুলির অনেকটা অংশই আর নেই। ভূমধ্যসাগরীয় ঝড় ড্যানিয়েল সাজানো শহরটাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। সুনামির মতো তীব্র আর বিশাল জলস্রোত বদলে দিয়েছে গোটা শহরের মানচিত্রকেই। অন্তত বন্যার আগে এবং পরের উপগ্রহচিত্র তা-ই বলছে।

সংবাদ সংস্থা বিবিসি যে উপগ্রহচিত্র প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বন্যার আগের ভূমধ্যসাগরের গাঢ় নীল জল রবিবারের পর রং বদলে হয়েছে ঘোলাটে সবুজ। শহরের মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া ওয়াদি ডারনা নদী দিয়েই সুনামির মতো জলস্রোত বয়ে গিয়ে মিশেছিল সাগরে। সেই নদীর দু’পাশে ছিল ঘন জনবসতি। সে সব স্রেফ ধুয়েমুছে গিয়েছে। রুক্ষ দেশ হলেও বন্দর শহর ডারনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল সবুজালি। সে সবের চিহ্ন নেই বন্যা পরবর্তী ডারনায়। বদলে চারপাশে শুধুই ঘোলাটে কাদা, জমা জল। ভেঙে গিয়েছে উপকূলকে বেড় দেওয়া রাস্তা। সমুদ্রের জলে বদলে গিয়েছে উপকূলরেখাটিও।

Advertisement

আগের ডারনা। ছবি: সংগৃহীত

গত ৪ সেপ্টেম্বর গ্রিসের উপকূলে ভূমধ্যসাগরের উপর তৈরি হয়েছিল সামুদ্রিক ঝড় ‘ড্যানিয়েল’। যার জেরে ৫ এবং ৬ সেপ্টেম্বর গ্রিসে রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছিল। গ্রিসের জাগোরা গ্রামের একাংশে ২৪ ঘণ্টায় ৭৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। যা ওই অঞ্চলের প্রায় ১৮ মাসের মোট বৃষ্টিপাতের সমান। এর পরেই রবিবার ঝড় আছড়ে পড়ে লিবিয়ার উপকূলে। ‘ড্যানিয়েল’-এর তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় আল-বায়দা, আল-মার্জ, তোবরুক, বাতাহ, বেনগাজি-র মতো শহর। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হয় ডারনার।

প্রবল বৃষ্টি এবং হড়পা বানে প্রথমে একটি বাঁধ ভাঙে ডারনা নদীর। তার পর তার জলের তোড়ে সশব্দে ভেঙে যায় আরও দু’টি নদীবাঁধ। বাঁধে জমা জল এর পরই সুনামির মতো বয়ে যায় শহরের উপর দিয়ে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় শহরের বাড়িঘর। বন্যার জলে খেলনার মতো ভাসতে দেখা যায় বাস, ট্রাক, গাড়িকে।

ছবি: রয়টার্স

১ লক্ষ ২৫ হাজার মানুষের বাস এই বন্দর শহরে। সরকারি হিসাবে এই জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশই হয় নিখোঁজ, নয় মৃত। লিবিয়ার বিমান পরিবহণ মন্ত্রী এবং পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসনের জরুরি পরিস্থিতি কমিটির সদস্য হিচেম আবু চকিওত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘শহরের ২৫ শতাংশ স্রেফ মুছে গিয়েছে।”

প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ে আহতের সংখ্যাও কম নয়। ডারনার সরকারি হাসপাতালে সেই জখমদের চিকিৎসার জায়গা নেই প্রায়। হাসপাতালের বাইরে কাতারে কাতারে পড়ে রয়েছেন জখম মানুষ। তাঁদের সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। মৃতদেহ চিহ্নিত করার জন্যও হাসপাতালে ভিড় করেছেন প্রিয়জনেরা। সব মিলিয়ে বেহাল দশা ডারনার।

ছবি: রয়টার্স

শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। জলের স্রোতে ভেঙে গিয়েছে রাস্তা। ভেঙে গিয়েছে ওয়াডি ডারনা নদীর উপরের একের পর এক সেতু। ফলে উদ্ধার প্রক্রিয়া ক্রমেই সমস্যাসঙ্কুল হয়ে পড়ছে। সমস্যায় রয়েছেন শহরের বাসিন্দারাও। গোটা শহর জল থইথই। কিন্তু এক ফোঁটা খাওয়ার জল নেই কোথাও। নেই খাবারও। সংবাদ সংস্থা সিএনএনের কাছে দুর্যোগের প্রস্তুতিতে ত্রুটির কথা স্বীকার করে নিয়ে লিবিয়ার ইমার্জেন্সি অ্যান্ড অ্যাম্বুল্যান্স অথরিটির প্রধান ওসামা আলি বলেছেন, “লিবিয়া এমন বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এর আগে এমন বিপর্যয় আমরা দেখিনি। স্বীকার করছি, ত্রুটি ছিল। যদিও প্রথম বার এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলাম আমরা।”

অন্য দিকে, ঘটনার দিন রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ডারনার বাসিন্দারা। আহমেদ মহম্মদ নামে এক জন সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, “আমরা তখন ঘুমোচ্ছিলাম। গোটা শহরই তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম ভাঙতেই দেখি বাড়ির চারপাশ দিয়ে জলের স্রোত বইছে। সে কী ভয়ঙ্কর স্রোত! সেই জল ১০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছ গিয়েছিল। আমরা বেরোনোর চেষ্টা করেও পারিনি। শেষে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিই।” শহরের আর এক বাসিন্দা রাজা সাসি। তিনি তাঁর স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে নিয়ে কোনও রকমে বেঁচে গিয়েছেন। রয়টার্সকে বলেন, “প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম, ভারী বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু মধ্যরাতে আমরা একটি বিশাল বিস্ফোরণ শুনতে পাই। পরে জানতে পারি, একটি বাঁধ ভেঙে গিয়েছে।”

ছবি: সংগৃহীত

সঙ্কট মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ১৬৮টি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল পাঠানোর ঘোষণা করেছেন। উদ্ধার অভিযানে সহায়তার জন্য প্রতিরক্ষা দল পাঠাচ্ছে ইতালিও। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমেরিকা। ত্রাণ পাঠিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরবও। যদিও লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যবদ্ধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ ডিবেইবা জানিয়েছেন, ১৪ টন ত্রাণ সমেত একটি বিমান ঝড়ে বিধ্বস্ত বেনগাজিতে পাঠানো হলেও বন্যাবিধ্বস্ত ডারনাতে এখনও ত্রাণ পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে শাসক মুয়াম্মর গদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশবাসী। পতন হয় সরকারের। নেপথ্যে ছিল ন্যাটো বাহিনী। তার পর থেকে পূর্বে বেনগাজি-কেন্দ্রিক প্রশাসন এবং পশ্চিমে ত্রিপোলি-কেন্দ্রিক প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ চলছে। তার প্রভাব পড়েছে বন্যাবিধ্বস্ত পূর্ব লিবিয়ার উদ্ধারকাজে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement