Nobel Peace 2018

যুদ্ধক্ষেত্রে নির্যাতিতাদের বাঁচানোর লড়াইকে কুর্নিশ! নোবেল শান্তি ডেনিস এবং নাদিয়াকে

যৌন অত্যাচারের শিকার মহিলাদের বাঁচাতে দিনে দশটি অপারেশন করার নজিরও আছে এই অক্লান্ত হার না মানা চিকিৎসকের। এক হাজারেরও বেশি মহিলাকে একার হাতে বাঁচিয়ে তোলার অনন্য নজির আছে এই বিরল চিকিৎসকের।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

অসলো (নরওয়ে) শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৬:২৯
Share:

কুর্নিশ। ডেনিস মুকওয়েগে এবং নাদিয়া মুরাদ। ছবি: সংগৃহীত।

দিনের পর দিন কেটে যেত। রাতের পর রাত। কখন খাচ্ছেন, কখন ঘুমোচ্ছেন, আদৌ খাচ্ছেন বা ঘুমোচ্ছেন কি না, বুঝতেই পারতেন না। স্নান, কাপড় কাচা, বাসন মাজা— বাড়ির সাধারণ কাজকর্ম? সে সবের কথাও কিছু মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে, একের পর এক পুরুষ ধর্ষণ করে চলেছে তাঁকে। এক... দুই... পাঁচ... দশ... কুড়ি... পঞ্চাশ... কত জন? হিসেব কষা হয়নি।

Advertisement

আইএস জঙ্গিদের হাতে তিন মাস বন্দি থাকা ইরাকি তরুণী নাদিয়া মুরাদকে ২০১৮-র নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে নরওয়ের নোবেল কমিটি। আইএসের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন যে হাজার হাজার ইয়াজ়িদি মহিলা, তাঁদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে চলেছেন ২৪ বছরের নাদিয়া।এই পুরস্কার তাঁর সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন শল্যচিকিৎসক ডেনিস মুকয়োয়েগে। কঙ্গোর বাসিন্দা, ৬৩ বছর বছর বয়সি ডেনিসকে ‘ধর্ষণ-ক্ষত মেরামতের সব থেকে অভিজ্ঞ ও দক্ষ চিকিৎসক’ বলে গণ্য করা হয়।

আজকের প্রাপকদের মধ্যে এক জন ধর্ষণের যন্ত্রণা সয়েছেন। কিন্তু তার পরেও হাল ছেড়ে দেননি। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরই মতো অন্য নিগৃহীতাদের জন্য। আর এক জন দু’দশক ধরে ধর্ষিতাদের যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দু’টি মহাদেশের অসমবয়সি এক নারী ও এক পুরুষকে এ ভাবে শান্তি-সূত্রে গেঁথে নোবেল কমিটি আজ বার্তা দিল, ‘‘যৌন নিগ্রহকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই দু’জন তার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এর থেকে বড় শান্তির বার্তা আর কী-ই বা হতে পারে!’’ ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে এক বক্তৃতায় ডেনিস বলেছিলেন, ‘‘যুদ্ধে রাসায়নিক, জৈবিক ও পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে। আমার আর্জি, ধর্ষণকে যুদ্ধের হাতিয়ার করাও নিষিদ্ধ হোক এ বার।’’ সেই আর্জিতেই সিলমোহর বসাল নোবেল কমিটি।

Advertisement

আরও পড়ুন: এগুলিই কি বিশ্বের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ?

চার বছর আগের কথা। উত্তর ইরাকের কোজো গ্রামে হামলা চালিয়েছিল আইএস জঙ্গিরা। উত্তর ইরাকের অনেক গ্রামের মতো এই গ্রামেও বাস করতেন মূলত ইয়াজ়িদি সম্প্রদায়ের মানুষ। গ্রামের পুরুষদের মেরে আর মেয়ে ও বাচ্চাদের বন্দি করে নিয়ে চলে যায় আইএস জঙ্গিরা। বাচ্চা ছেলেদের ধর্মান্তরিত করে জঙ্গি হওয়ার তালিম দেওয়ার জন্য। আর বালিকা থেকে বয়স্ক মহিলা, সবাইকে বানানো হয় যৌনদাসী। আইএস ‘যোদ্ধা’রা পালা করে ধর্ষণ করে সেই মেয়েদের। উনিশ বছর বয়সি নাদিয়াও ছিলেন সেই যৌনদাসীদের দলে।

বন্দিদশার প্রথম দিকে এক বার পালানোর চেষ্টা করেছিলেন নাদিয়া। ধরা পড়ার পরে শুরু হয় গণধর্ষণ। আইএস জঙ্গিদের ভাষায় ‘শাস্তিমূলক যৌন জেহাদ’। বছর দুই আগে এক সাক্ষাৎকারে নাদিয়া বলেছিলেন। ‘‘শুধু ধর্ষণ নয়, সিগারেটের ছেঁকা দেওয়া, যৌনাঙ্গে অস্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া, অত্যাচারের তালিকাটা ছিল বিশ্রী রকমের লম্বা। অনেকেই সহ্য করতে পারত না। আমারই গ্রামের একটা মেয়ে তো আত্মহত্যা করল।’’

তিন মাস পরে ফের পালানোর সুযোগ পান নাদিয়া। আইএস ডেরা থেকে পালিয়ে কড়া নাড়েন একটা বাড়িতে। সেই বাড়ির মানুষদের বলেন, ‘‘আমি মুসলিম নই, ইয়াজ়িদি। কিন্তু দয়া করুন আমাকে। রক্ষা করুন।’’ তাদের সাহায্যেই আইএস এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নাদিয়া। আশ্রয় নেন উত্তর ইরাকের দুহোক শরণার্থী শিবিরে। সেখানে থাকাকালীন তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল বেলজিয়ামের এক সংবাদপত্রে। তার মাধ্যমেই পশ্চিমি দুনিয়া চিনে নেয় নাদিয়াকে। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের শুভেচ্ছাদূত নির্বাচিত হন তিনি। তার কিছু দিন পরেই চলে আসেন জার্মানিতে। সেখান থেকেই ইয়াজ়িদি মহিলাদের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নাদিয়া।

আরও পড়ুন: গান গেয়ে মেশিনগানের জবাব দিচ্ছে গাজ়া

কঙ্গোর বুকাভুতে পানজ়ি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চিকিৎসক ডেনিস মুকয়োয়েগের লড়াইটা অনেকটাই অন্য রকম। আবার অন্য রকম নয়-ও। ডেনিসের কথায়, ‘‘সেটা ১৯৯৯। তখন আমি বুকাভুর একটা হাসপাতালে কাজ করি। হঠাৎ এক মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। সমানে কাতরাচ্ছেন। শুধু বললেন, ‘আমায় ধর্ষণ করা হয়েছে। অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছু একটা করুন।’ পরীক্ষা করে দেখি, শুধু ধর্ষণ নয়। মহিলার যৌনাঙ্গের ভিতরে গুলি চালিয়েছে কেউ। ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে ভেতরটা, উরুর একটা অংশও।’’ সেই শুরু। তার পর ৮৫ হাজারেরও বেশি ধর্ষিতার চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার করেছেন ডেনিস। নিগৃহীতারা সকলেই কয়েক দশক ধরে চলা কঙ্গোর গৃহযুদ্ধের শিকার। ‘‘নোবেেলর খবরটা পাই হাসপাতালে কাজ করতে করতেই। দিনের দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারটায় সবে হাত দিয়েছি। টিভি দেখে সবাই হই হই করে উঠল।’’

এখনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি নাদিয়ার। তিনি আদৌ খবরটা পেয়েছেন কি না, জানা যায়নি তা-ও। নোবেলের তালিকায় এই প্রথম এক ইরাকির নাম উঠল। দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ নোবেল প্রাপকও তিনি। চার বছর আগে ১৭ বছর বয়সে শান্তির নোবেল জিতেছিলেন আর এক বীরাঙ্গনা, পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজ়ায়ি।

(আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ- সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের আন্তর্জাতিক বিভাগে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement