একটা ছোট্ট ফ্রক। তাতে রক্তের ছোপ লেগে। ফ্রেমে বাঁধানো সেই ফ্রকটা নজর কেড়েছিল প্রথমেই। মিউজিয়ামে এমন একটা ফ্রক বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে কেন?
উত্তরটা ফ্রেমের ঠিক নীচেই লেখা আছে!
ছ’মাসের রেহানা। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের বাড়িতে এসে বাবাকে পায়নি। উঠোনে তখন খেলছিল ছোট্ট রেহানা। বুটের নীচে ফেলে তাকে পিষে মারে তারা। বাড়ি ফিরে বাবা আর মেয়ের দেখা পাননি। মেয়ের স্মৃতি হিসেবে ওই ছোট্ট ফ্রকটা বাঁধিয়ে রেখেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি হচ্ছে জেনে নিজের ওই সম্বলটুকু দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষকে। দেশের স্বাধীনতায় তাঁর ছ’মাসের ছোট্ট মেয়েরও যে একটা ভূমিকা ছিল, সে কথা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন তিনি।
একটা ভাড়া বাড়িতে স্বাধীনতার ২৫ বছরে, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের মার্চে চালু হয়েছিল ওই মিউজিয়াম। মুক্তিযুদ্ধের বহু নথি, অসংখ্য চিঠিপত্র, যুদ্ধে ব্যবহৃত বহু সরঞ্জাম আর অজস্র ছবি ঠাঁই পেয়েছে সেখানে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, কোনও ভুল তথ্য যাতে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সেই কারণেই প্রকৃত তথ্য সরবরাহের চেষ্টা করেছেন তাঁরা। তবে শুধু তথ্যের কচকচি নয়, মিউজিয়ামে রয়েছে দেশকে ঘিরে সাধারণ মানুষের ছোট ছোট নানা আবেগের প্রতিচ্ছবিও। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কথায়, আমরা কোনও কিছুর ব্যাখ্যা করে দিতে চাইনি। প্রকৃত সত্য তুলে ধরেছি। ব্যাখ্যার ভার মানুষের নিজের।
তাঁরা ব্যাখ্যা করুন বা না করুন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আবেগের কখনও কোনও ঘাটতি হয়নি। বরং ওই মিউজিয়ামে নিজেদের যে কোনও সম্বল অকাতরে দান করতে চেয়েছেন তাঁরা। মিউজিয়ামের কর্ণধার মফিদুল হক বলেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলাচ্ছে। আমাদের সংগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। তা ছা়ড়া একটা মিউজিয়াম চালু রাখতে গেলে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যথাযথ আলোর ব্যবহার, দূষণ ঠেকানোর যে ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন হয়, ভাড়া বাড়িতে সেটা সম্ভব নয়। এই কারণেই নতুন বাড়ির কথা ভাবতেই হয়েছে।’’
আপাতত সব কিছু প্রস্তুত। কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারও। জমির মূল্যে কিছুটা ছাড়ের পাশাপাশি ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পে এসেছে সরকারি আর্থিক সাহায্যও। যদিও মফিদুল হক জানিয়েছেন, সরকারি সাহায্যকে তাঁরা স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু সেই সরকার যেন সহায়কের ভূমিকা থেকে নির্ধারকের ভূমিকা না নিতে পারে, সে ব্যাপারেও তাঁরা সতর্ক আছেন।
আর কয়েক দিন পর অস্তিত্ব থাকবে না চট্টগ্রাম অস্ত্রাগারের।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবীতেই একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ‘সাইটস অফ কনসার্ন’ হিসেবে পৃথিবীর আরও আটটি মিউজিয়ামের সঙ্গে আপাতত এটি জোটবদ্ধ। এমন একটি মিউজিয়ামের সম্প্রসারণের কাজে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এখনও কিছু অর্থ জোগাড় করা বাকি। কিন্তু যে ভাবে তামাম বিশ্বের মানুষ এই কাজে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তাতে তাঁরা আশাবাদী, শেষরক্ষা হবেই।
মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে আপামর বাংলাদেশবাসীর আবেগের শেষ নেই। ’৭১-এর গণহত্যার যড়যন্ত্রে জড়িতদের ফাঁসিতে দেশবাসীর মিলিত উল্লাসে যেমন তার ছাপ, তেমনই স্বাধীনতার এত বছর পরেও ওই মিউজিয়ামে নিয়মিত বিভিন্ন বয়সের মানুষের ভিড় দেখেও তা আঁচ করা যায়।
মিউজিয়াম দেখে যেমন সে দেশের মানুষের ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা সম্পর্কে শ্রদ্ধা তৈরি হয়, তেমনই মুজিবর রহমানের বাড়িতে যে ভাবে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম তৈরি হয়েছে, আর সেখানে যে ভাবে তাঁর জীবনের অসংখ্য ঘটনাকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে, তা দেখে বিস্মিত না হয়েও পারা যায় না। বাড়ির ঠিক যে অংশে বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করা হয়েছিল, সেই দেওয়ালে রক্তের দাগ এখনও স্পষ্ট। স্পষ্ট দেওয়ালে গুলির চিহ্নও। বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর কী ভাবে সংরক্ষিত হয়েছে, কী ভাবে সংরক্ষিত হয়েছে সেই সব ঘরের মানুষদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, তা মুগ্ধ করার মতো।
কিন্তু এক দিকে যদি এমন ইতিহাস সচেতনতা, তা হলে অন্য দিকে ইতিহাসের আর এক অধ্যায় নিয়ে এমন উদাসীনতা কেন? বাংলাদেশ সফরে গিয়ে অবশ্য গন্তব্যের তালিকায় ছিল চট্টগ্রাম। আর তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দেখা। যদিও সেখানে পৌঁছে দেখলাম, পরিত্যক্ত কয়েকটা ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই। এমনকী, একটা ফলক পর্যন্ত না। ঠিক ওই জায়গাতেই যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার ছিল, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। ওই জমির মালিক এখন রেল দফতর। চলছে নতুন নির্মাণের কাজ। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবীণ মানুষেরা জানালেন, আর মাস কয়েক পর ওই পরিত্যক্ত ঘরগুলিরও কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ সেখানে নতুন বাড়ি তৈরি হবে।
যে বাংলাদেশ ইতিহাসের একটা অধ্যায় নিয়ে এতটা আবেগপ্রবণ, অন্য একটা অধ্যায় তারা এত অবলীলায় ভুলে থাকে কী করে!