ঢাকায় দেওয়াল লিখন। —নিজস্ব চিত্র।
ভিড়ের মধ্যেই সবচেয়ে নির্জনতা রয়েছে!
শুধু জীবনানন্দের কাব্যচেতনা নয় এটি। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের হাতে-কলমে অভিজ্ঞতাও বটে। সবার চোখের সামনে, ভিড়ভাট্টার মধ্যেই এক ধরনের সহজাত আড়াল তৈরি হয়ে যায়। কারও সঙ্গে গোপনে কথা বলার এটা অন্যতম সেরা এক উপায়।
এ বারে পরিবর্তনের পর ঢাকা শহরেও এমনটা ঘটল। শহরের উত্তরা থেকে মতিঝিল, প্রায় ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রো রেলের কাজ পুরোটাই হয়েছে হাসিনা সরকারের জমানায়। উদ্বোধনও হয়েছে জানুয়ারি মাসে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সময়ে। এই প্রকল্পে ভারত যে অংশ নিয়েছে তা বুঝতে পারা যায় রাস্তার প্রবেশদ্বার থেকে নীচে নেমে এলে। হুবহু দিল্লি মেট্রোর চেহারা যেন। তবে অফিস টাইমের বাইরে এই ভরদুপুরে যে মারাত্মক ভিড় হয় তেমনটা দিল্লিতে নেই। উপরের কাঁচা বাজারগুলোও ভিড়ে ভিড়াক্কার। ঘিঞ্জি পাড়ায় রিকশার জট। আবার অন্য দিকে দিল্লির অভিজাত টেরাকোটা টেলস-এর কাফেয় যুবক-যুবতীরা রিল তুলতে ব্যস্ত।
ভিড়ের মধ্যেই টুকরোটাকরা স্বর ভেসে আসে। সদ্য নিষিদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ। তাদেরই এক নেতা ওবায়েদুল মামুদ (নাম পরিবর্তিত) বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাচ্ছেন, “নির্বাচনে যত বিলম্ব হবে, আওয়ামী লীগ তো বটেই, বিএনপি-র পক্ষেও পরিস্থিতি তত কঠিন হয়ে যাবে। কারণ লন্ডনবাসী তারেক জিয়ার (খালেদা পুত্র) বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা তুলে না নিলে এবং দেশে ফিরে আসতে না দিলে বিএনপি-র নেতৃত্বহীনতার সঙ্কট বাড়বে বই কমবে না। খবর হল, মামলা তুলে তারেকের বাংলাদেশে আসার পথ প্রশস্ত করার কোনও ইচ্ছাই নেই ইউনূস সরকারের। বরং খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ, তাঁকেও চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশ পাঠানোর তোড়জোড় চলছে। দুই শীর্ষ নেতাকে ছাড়া বিএনপি-র কোমর ভাঙাই বলা যায়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মতোই বিএনপি-র বাকি শীর্ষ স্তরের নেতাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সময়ে নাশকতার মামলা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ‘মাইনাস টু’ অর্থাৎ বিএনপি এবং অবশ্যই আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে ভোটের প্রস্তুতি করা, মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য সুবিধাজনক হবে।” তাঁর কথায়, “আওয়ামী লীগেরও এখন কোনও অস্তিত্ব ঢাকার রাজপথে নেই। বিএনপি-র সঙ্গে আমাদের একযোগে পথে নামার মতো কোনও সম্ভাবনা (বিএনপি চাইলেও) দেখা যাচ্ছে না আপাতত। দলের প্রবীণ নেতারা ফেসবুক পেজে কিছু বিবৃতি দিচ্ছেন মাত্র। কিন্তু আন্দোলন তো করতে হবে কর্মীদের। তাঁরা হয় পলাতক, নয় গা ঢাকা দিয়েছেন অথবা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জেরে বন্দি।”
অন্য দিকে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন করা হবে এমন একটি বার্তা দেশবাসীকে এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক মহলকে (আমেরিকাকে) দিতে চাইছেন মুহাম্মদ ইউনূস। আর সে কারণে তড়িঘড়ি ছ’সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে নতুন নির্বাচন কমিশন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া শেষ হবে কবে তার কোনও সময়সীমা দেওয়া হয়নি। তার আগে ছ’টি ক্ষেত্রে সংস্কারের গতিমুখ নির্ধারণের জন্য ৬টি কমিটি গড়াও হয়েছে। কথা রয়েছে তারা এই বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে রিপোর্ট জমা দেবে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে (আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের ছাড়া) আলোচনায় বসবে অন্তর্বর্তী সরকার। একটি সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, বিএনপি চায় যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু এই সংস্কারের ফাটল দিয়েই ফের বড় মাপের অশান্তি তৈরি হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
নির্বাচনের জন্য যে মুখিয়ে রয়েছে বিএনপি, তা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তথা বাংলাদেশের প্রাক্তন বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরুর কথায় স্পষ্ট। তিনি বলছেন, “২০১৮ সালে আমরা শেষ বারের মতো ভোটে যোগ দিতে পেরেছি। তখনও আমার বাড়ির সামনে ভোটের দিন দুটো মাইক্রোবাসে সশস্ত্র লোকজন দাঁড়িয়ে থাকত। আমরা বর্তমান ব্যবস্থার সংস্কার চাই ঠিকই। সে জন্য একুশ দফা প্রস্তাবও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। আমাদের দাবি হল, কেউ যেন দু’বারের বেশি ক্ষমতায় না থাকে, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যেন ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে, কেউ যাতে স্বৈরতান্ত্রিক শাসক হয়ে উঠতে না পারে, এ সব দেখা। কিন্তু কথা হল, এই সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়া, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা, সংবিধান-সহ সব বিষয়ে প্রার্থিত সংস্কার স্বল্প সময়ের মধ্যে করে উঠতে পারবে, এমনটা তো নয়। অন্তত দশটি বিষয়ে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য হলে ভোট করে জাতীয় সংসদ গড়া হোক। যেগুলিতে এই সরকারের সঙ্গে একমত হব না সেগুলি নিয়ে আমরা মানুষের কাছে যাব ভোট চাইতে। তার পর নির্বাচিত সংসদ সংস্কারগুলি পাশ করাবে।”
কবে হতে পারে এই ভোট? মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলমের কথায়, “এখনও পর্যন্ত নির্বাচনের জন্য কোনও সময়রেখা নির্ধারণ করা হয়নি। আগামী ছ’মাস খুবই কম সময় সংস্কারের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ভোটের ব্যবস্থা করার জন্য। তবে যা হবে বছর দু’য়েকের কম সময়েই হবে।” ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলোচনার পরিকল্পনা এবং ইচ্ছা রয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের। পরবর্তী বিমস্টেক সম্মেলন বসবে তাইল্যান্ডে, যার তারিখ এখন চূড়ান্ত হয়নি। ওই বৈঠকে ইউনূস এবং মোদীর যোগ দেওয়ার কথা। শফিকুল আলমের কথায়, দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আদানপ্রদান অটুট থাকা উচিত। বাণিজ্যের জন্য ভারতকে যে প্রয়োজনও সে কথাও জানান তিনি। জানানো হয়েছে, ভারতে ইলিশ রফতানিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে দৃষ্টান্তমূলক বার্তা দিতে। সম্প্রতি ভারত থেকে সাড়ে চার কোটি ডিমও আমদানি করেছে ঢাকা। সে দেশে সাম্প্রতিক বন্যার পরে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তাকে সামাল দিতেই এই আপৎকালীন আমদানি।