Coronavirus

সংক্রমণ রুখতে নিউজিল্যান্ডের কৌশল ফের শূন্য থেকে শুরু

প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে যে যতই এগিয়ে থাকুক না কেন, পৃথিবীর কোনও দেশ-ই এরকম প্রতিকূল অবস্থার জন্য তৈরি ছিল না। নিউজিল্যান্ডের বিষয়ে আলোচনা করার আগে, কয়েকটি অন্যান্য দেশ সম্বন্ধে জানাতে চাই।

Advertisement

মৌমিতা দাস রায়

অকল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২০ ১৪:৫৪
Share:

প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা দেশও এই রকম প্রতিকূল অবস্থার জন্য তৈরি ছিল না।

প্রথমেই পরিষ্কার জানিয়ে রাখি, ৫০ লক্ষ জনসংখ্যার একটি দ্বীপরাষ্ট্রের পক্ষে যেটা ভাবা ও করা সম্ভব, সেটা আমাদের মত বড় ও বিপুল জনসংখ্যার দেশে কখনওই সম্ভব না। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে যে যতই এগিয়ে থাকুক না কেন, পৃথিবীর কোনও দেশই এরকম প্রতিকূল অবস্থার জন্য তৈরি ছিল না। নিউজিল্যান্ডের বিষয়ে আলোচনা করার আগে অন্যান্য কয়েকটি দেশ সম্বন্ধে জানাতে চাই।

Advertisement

ফাঁকা রেস্তরাঁ ভরানোর জন্য কয়েকটি টেবিলে বসানো রয়েছে মানুষ-সমান পুতুল।

বলা হচ্ছে এখনও অবধি করোনা প্রবেশ করেনি উত্তর কোরিয়া ও তুর্কমেনিস্তানে। এই দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনীতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে, তারা কী ভাবে করোনা দূরে রেখেছে সেটা আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়। এ ছাড়া রয়েছে ওশেনিয়া মহাদেশের কয়েকটি দ্বীপ দেশ- যেমন কিরিবাতি, সামোয়া, টঙ্গা। করোনা অতিমারি রূপ ধারণ করার অনেক আগেই এই সমস্ত দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। এখনও বন্ধ রেখেছে। এই দেশগুলি মূলত পর্যটনকেন্দ্রিক, আমদানি নির্ভরও বটে। জিডিপি ও অন্যান্য মাপকাঠির পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু এরা অতি ক্ষুদ্র, এই দেশগুলির অর্থনীতির কী অবস্থা তা আমরা জানতে চাই না। কিন্তু করোনা নেই বলেই যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা, এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই।

Advertisement

দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, মরোক্কোর মতো কয়েকটি দেশ করোনা পরিসংখ্যানের সিংহভাগ দখল করে রয়েছে। তার মানে কি মধ্য আফ্রিকায়, সাহারা স্যান্ড-বেল্টের নিচের প্রায় চল্লিশটি দেশে, করোনা সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি? প্রথমেই যেটা মাথায় আসে সেটা হল উগান্ডা, বুরুন্ডি বা দক্ষিণ সুদানের মতো দেশে কি যথেষ্ট সংখ্যায় করোনা পরীক্ষা হচ্ছে? আমি বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের লেখা পড়েছি ও যা বুঝেছি তাতে চারটি মূল ভাবনা উল্লেখযোগ্য:

১) আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ, বিশেষত পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ইবোলা মোকাবিলায় নিজেদের অনেকটা প্রস্তুত রেখেছিল, যেটা করোনার বেলায় কাজে লেগেছে। ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে বহু বছরের লড়াইও এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে।

২) শুরু থেকেই আগ্রাসী উপায় নির্দিষ্ট করে করোনা রোগীদের চিহ্নিত ও আইসোলেট করা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও কোয়রান্টিন করা।

৩) আফ্রিকা মহাদেশে মানুষের গড় বয়স মাত্র ২০ বছর, এই কারণে এই রোগে ভয়ঙ্কর ভাবে আক্রান্ত হওয়া বা এর কারণে মৃত্যুহার অনেকটাই কম।

৪) চতুর্থ ও কিছুটা হলেও আশ্চর্যজনক কারণ হল আফ্রিকার আবহাওয়া, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও অনেকটা ম্যাজিক!

আমাদের দেশের মতোই অবস্থা ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের। এটা একেবারেই আজব ব্যাপার নয়! আমি বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছি এই সব দেশে, কাছ থেকে দেখেছি এই মানুষগুলোকে। খাওয়া দাওয়া, আদব কায়দায় অনেক মিল পেয়েছি আমাদের দেশের মানুষের সঙ্গে। পরিবারের অনেকের সঙ্গে থাকা, বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনকে জড়িয়ে ধরা, এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করা, অনিয়ম করার বেলায়ও অনেক মিল। কাজেই এই দেশগুলোতেও যে হুড়মুড়িয়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে, সেটা একরকম স্বাভাবিক। ব্রাজিল এবং মেক্সিকো— জনবহুল দুটো দেশেও মৃতের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। প্রতি হাজার জন মানুষের ওপর ব্রাজিল পরীক্ষা করছে ২৭ জনের, মেক্সিকো ১১ জনের। সব থেকে বেশি সংখ্যায় টেস্ট করছে চিলে, প্রতি হাজার জন পিছু ১৭০ জনের। সেখানে, আমাদের দেশে পরীক্ষা হচ্ছে ৫৩ জনের। বিশ্বে সব থেকে বেশি সংখ্যায় পরীক্ষা করছে ডেনমার্ক ৬৪৪, তারপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- ৩৩৬ ও রাশিয়া- ৩০৯।

প্রতি হাজারে কোন দেশ কত করোনা পরীক্ষা করছে।

ইউরোপ ও আমেরিকা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি সারাক্ষণই চলছে। এদের সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই। অনেকেই বলছেন ইউরোপে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। স্পেন, ফ্রান্সের মতো অনেক দেশ নতুন করে লক ডাউনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। শীত পড়া শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই করোনা গ্রাফও আবার উর্দ্ধমুখী। OECD দেশগুলির মধ্যেও করোনা মোকাবিলায় সাফল্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন অস্ট্রিয়া, জার্মানি, আইসল্যান্ড বা নরওয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে ইতালি, ইউকে বা বেলজিয়াম এর তুলনায়। এর কারণ হিসেবে আমি মনে করি এই দেশগুলির স্বচ্ছল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উন্নতমানের চিকিৎসা পরিকাঠামো, সাধারণত সুশৃঙ্খল নাগরিক ও সর্বোপরি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।

এবার আসা যাক নিউজিল্যান্ডের কথায়। এই দেশে আমি কর্মসূত্রে রয়েছি কয়েক বছর। প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন ও তাঁর রাজনৈতিক দলের মত অনুযায়ী নিউজিল্যান্ডকে করোনা মুক্ত হতে হবে। এর অর্থ, গোষ্ঠী সংক্রমণ হবে শূন্য। এটাই করোনা এলিমিনেশন স্ট্র্যাটেজি। বাইরে থেকে যারা আসছেন, তাদের নিজেদের খরচে ১৪ দিনের কোয়রান্টিনে থাকতে হবে বাধ্যতামূলক। এই নিয়মে চলে, জুন মাসের শুরুতে, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যতে নামিয়ে আনতে সফল হয় নিউজিল্যান্ড। টানা তিন মাস চলে এই অবস্থা। স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বের মানচিত্রে অনেকটাই বড় হয়ে যায় এই ছোট্ট দেশটা। সবার কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে জ্বলজ্বল করতে থাকে। সেই সঙ্গে টানা ১০২ দিন পর হঠাৎই সামনে আসে গোষ্ঠী সংক্রমণ। শুরু হয় তর্ক বিতর্ক, বিরোধী পক্ষের দোষারোপ, ওঠে তথ্য গোপন করার মত অভিযোগও। এখানে বলে রাখা দরকার যে অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখ নিউজিল্যান্ডের সাধারণ ভোট , কাজেই করোনাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়। জনসংখ্যা কম, অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব শুধু আকাশপথে বা জলপথে। এলিমিনেশন স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা কিছুটা হলেও সম্ভব, কিন্তু এই উপায় বাস্তবে কতটা সফল হল সেটা নিয়ে চলছে প্রচুর চাপানউতোর ।

ভোট প্রচার চলছে পুরো দমে।

কী অবস্থা এখন এই দেশের মানুষের? সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যের পর্ব শেষ। চাকরি নেই বহু মানুষের। যাদের আছে, তাদের কাউকে বলা হচ্ছে জমানো ছুটি নিতে অথবা সপ্তাহে কাজের দিন কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রচুর ছোট ব্যবসা। রেস্তরাঁ, কফি শপ, বা ট্রাভেল এজেন্সি। যে সমস্ত রেস্তরাঁ এখনও ধুঁকছে, তাদের মধ্যে কেউ বা টেবিল ভরাচ্ছে মানুষ-সমান পুতুল দিয়ে কেউ বা দিনে মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যে খুলছে। কিছুদিন আগে একটি রেস্তোরাঁ বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখলাম মাত্র এক ডলারে (৫০ টাকার মত)। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে চালাতেন এই রেস্তরাঁ, স্বামী আটকে আছেন ফিলিপিন্সের ম্যানিলা শহরে, স্ত্রী একা টানতে পারছেন না ভাড়া ও আনুষাঙ্গিক খরচ, কাজেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। জানেন না এরপর কী করে চলবে তাদের। এরকম অনেক কাহিনী রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অকল্যান্ড শহরের ব্যস্ততম রাস্তা কুইন স্ট্রিটে বন্ধ হয়ে গেছে বহু রিটেল স্টোর, প্রায় জনমানবহীন শহরের বড় শপিং মল। সরকার সবাইকে অনুরোধ করছে লোকাল, ছোট ব্যবসাকে সাহায্য করার জন্যে। ডোমেস্টিক ট্যুরিজম খুলছে আস্তে আস্তে, বড়দিনের ছুটিতে নিউজিল্যান্ডের মধ্যেই বেড়াতে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

আমাদের মধ্যে কারও কারও জীবন পাল্টে গেছে আমূল। কেউ বা প্ল্যান করা অনেক কিছুই শুরু করতে পারছেন না। যেন থমকে আছে সব। ফিলিপিনো দম্পতির মতো আমরা অনেকেই জানি না ভবিষ্যত কী হবে। এর মধ্যেও যে যার মতো করে চালিয়ে যাচ্ছি টিকে থাকার লড়াই। খুঁজে নিচ্ছি ছোট ছোট আনন্দ, অপেক্ষায় আছি কবে বাড়ি ফিরব, সবার সঙ্গে দেখা হবে সামনাসামনি, ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে না। গতকালই খুব সুন্দর একটা রামধনু দেখলাম। এখানে এখন বসন্ত এসেছে, শরৎ না। কিন্তু পুজো আসছে এখানেও ।

আমার দেখা রামধনু।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement