গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ভোট শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগেও আমেরিকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের দাপুটে ‘পোলস্টার’দের অধিকাংশই এগিয়ে রেখেছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসকে। সেই সঙ্গে ছিল ‘ফোটো ফিনিশে’ জয়-পরাজয় নির্ধারণের পূর্বাভাস। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে গণনা শেষের ঢের আগেই রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বারের জন্য হোয়াইট হাউসে প্রবেশের বন্দোবস্ত পাকা করে ফেললেন। সেই সঙ্গে ডোমোক্র্যাটদের পিছনে ফেলে আমেরিকার কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সেনেট এবং নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ রিপ্রেজ়েনটেটিভস’-এও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল তাঁর দল।
২০১৬-য় হিলারি ক্লিন্টনের পরে ২০২৪-এ কমলা হ্যারিস। আট বছরের ব্যবধানে দু’বার আধুনিক বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ আটকে দিলেন ট্রাম্প। যাবতীয় জনমত সমীক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বাজিমাত করল ৭৮ বছরের বিতর্কিত নেতার ‘পপুলিজ়মে’র রাজনীতি। কোন অঙ্কে এল এই সাফল্য। নানা বিশ্লেষণে উঠে আসছে তিনটি ‘ট্রাম্প কার্ড’-এর তত্ত্ব— মূল্যবৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা এবং পশ্চিম এশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থীর দৃঢ় অবস্থান। কমলার মূল লক্ষ্য ছিল, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনোজ়, আফ্রিকান-আমেরিকান, মহিলা, কলেজ শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ যুবসমাজ এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের সমর্থন পাওয়া। কিন্তু শেষ চারটি ক্ষেত্রেই কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। গত আট মাস ধরে ২০টি সাক্ষাৎকার এবং ধারাবাহিক প্রচারে ভর করে বাজিমাত করলেন ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট ভোটে প্রদেশভিত্তিক ফল।
মূল্যবৃদ্ধি
মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত আমেরিকায় এ বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রামীণ ভোটারদের বড় অংশ চিরাচরিত ভাবে রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। কিন্তু শহরের শ্রমিক-কর্মচারী শ্রেণি সাধারণ ভাবে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদেরই ভোট দিতেন। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত অনেক ডেমোক্র্যাট ভোটার ট্রাম্পকে অপচ্ছন্দ করলেও এ বার শেষ মুহূর্তে তাঁর প্রতি আস্থা রেখেছেন। অনেকে আবার বুথমুখো হননি। যা কিছু ‘দোদুল্যমান’ প্রদেশে এ বার তাঁকে জিতিয়েছে।
আমেরিকায় মূল্যবদ্ধি, আর্থিক মন্দা এবং উৎপাদন শিল্পের অধোগতিকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প এঁদের মনে আউটসোর্সিং, ছাঁটাইয়ের ভয় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বার বার ভোটদাতাদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন— ‘‘বাইডেনের আমলে কি আপনারা ভাল আছেন?’’ কাজ হারানোর ফলে বা হারানোর আশঙ্কায় শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি অংশ ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে। সামগ্রিক ভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে সাড়া ফেলেছে তাঁর আবেদন। এমনকি, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনোজ় আর কৃষ্ণাঙ্গ প্রভাবিত পেনসিলভেনিয়াতেও!
প্রেসিডেন্ট ভোটে ট্রাম্প কার্ড।
অভিবাসন সমস্যা
আমেরিকায় এ বারের নির্বাচনে মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি অভিবাসন সমস্যা নিয়ে প্রচার বড়সড় প্রভাব ফেলেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন। বিশেষত, ‘রাস্ট বেল্ট’ হিসাবে পরিচিত প্রদেশগুলিতে ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করছে ডেমোক্র্যাটদের চিরাচরিত শ্রমিক-কর্মচারী ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরাতে পেরেছেন ট্রাম্প। প্রচারের তিনি বার বার বলেছেন, ভোটে জিতলে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করবেন। সুরক্ষিত করবেন কলকারখানা, দফতরের কর্মীশ্রেণির আমেরিকানদের আর্থিক নিরাপত্তা। ফল বলছে, সেই প্রচার প্রভাব ফেলেছে ভোটে।
ভোটের আগে প্রকাশিত একটি জনমত সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অভিবাসনের বিষয়টিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া ভোটারদের সংখ্যা ৪.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৫ বছরে এই সংখ্যা সব থেকে বেশি বেড়েছে ’২১ থেকে ’২৪-এর মধ্যে বাইডেনের জমনায়— প্রায় ৫.৪ শতাংশ। বর্তমানে আমেরিকায় চার কোটি ৭৮ লক্ষ অভিবাসী বসবাস করেন। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ এমনকি, কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক-কর্মচারীদের অনেকে মনে করেছেন তাঁদের রোজগারের নিশ্চয়তায় আঘাত হানছেন অভিবাসীরা। কমলা অভিবাসন নিয়ে কড়া অবস্থান ঘোষণা না করায় ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন তাঁরা।
২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে মেক্সিকো-আমেরিকা সীমান্তে প্রাচীর তোলা, বহু অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো, সীমান্তে পরিবারগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বাচ্চাদের পরিবারের থেকে আলাদা করা— এমন নানা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে যখন বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন, তাঁর নীতি হয় সীমান্তে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে মানবিকতা বজায় রেখে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ২০২০-র ডিসেম্বরে যেখানে মেক্সিকো সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার। ২০২৩-এর ডিসেম্বরে তিন লক্ষে পৌঁছয়। সীমান্ত শহরগুলিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সেই পরিস্থিতিতে টেক্সাস, ফ্লরিডার মতো প্রদেশগুলির গভর্নরেরা বাস ভর্তি করে বহু অবৈধ অভিবাসীকে নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলসের মতো এলাকায় পাঠিয়েছিলেন। সে সময় প্রকাশিত একটি জনমত সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, আমেরিকার ৩৫ শতাংশ ভোটার জোরালো ভাবে মনে করেন যে, কোনও পরিচয়পত্রহীন শরণার্থীদের সংখ্যা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করল সেই সমীক্ষায় ভুল ছিল না।
ইজ়রায়েল, ইউক্রেন এবং অন্যান্য
সেপ্টেম্বরের গোড়ায় পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের রাজধানী ফিলাডেলফিয়ায় আয়োজিত মুখোমুখি বিতর্কে (প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট) ট্রাম্প জানিয়েছিলেন নির্বাচিত হয়ে পশ্চিম এশিয়ায় অশান্তি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবেন তিনি। সেই সঙ্গে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ছিল— ‘‘আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেব।’’
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে ভলোদিমির জ়েলেনস্কির বাহিনীকে ধারাবাহিক ভাবে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বাইডেন সরকার। অন্য দিকে, ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর গাজ়া থেকে প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইজ়রায়েলে হামলা চালানোর পর শুরু হয়েছে ধারাবাহিক অশান্তি। লেবাননের হিজ়বুল্লা এবং ইরানের সঙ্গে ইজ়রায়েলের সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে। যার জেরে তিন দফায় উপসাগরীয় অঞ্চলে বাড়তি সেনা পাঠাতে হয়েছে পেন্টাগনকে। তার অভিঘাত এসেছে আমেরিকার করদাতাদের পকেটে।
এই পরিস্থিতিতে একাংশ বিশ্বাস করেছেন, স্বভাবে বেপরোয়া ট্রাম্প ইজ়রায়েল এবং ইউক্রেন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের পুরনো সমীকরণও মাথায় রেখেছেন ভোটদাতাদের অনেকে। ভরসা করেছেন তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ স্লোগানে। পাশাপাশি, ইসলামিক মৌলবাদে ভীত জনতার একাংশ ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্যে নীরবে সমর্থন জুগিয়েছেন।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের ‘গর্ভপাতের অধিকার বিরোধী অবস্থান’ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। সে বার বাইডেনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। এ বারের ভোটপ্রচারে সন্তর্পণে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল নারীবাদীদের নিশানা এড়ানো। ভোটের ফল বলছে এই কৌশল সফল হয়েছে। অন্য দিকে, চার বছর আগেকার ক্যাপিটল হিংসা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট শিবির প্রচার চালালেও তা জনমানসে প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফল মেলেনি, ‘ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট’ প্রচারেও। বস্তুত, কমলার পরিশীলিত, পরিসংখ্যানভিত্তিক যুক্তির সামনে তিনি যে সুবিধা করতে পারবেন না, তা ফিলাডেলফিয়ার ডিবেটেই বুঝেছিলেন ট্রাম্প। তার পরে আর মুখোমুখি বিতর্কে অংশই নেননি তিনি।