লন্ডনে সরস্বতী পুজো বেশ জমজমাট। —নিজস্ব চিত্র।
ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ ভাগে আইবিথা দ্বীপে সূর্যাস্তের সময় স্প্যানিশ রিসর্টের খোলা উঠোনের মতো বিশাল ব্যালকনিতে কেউ পিয়ানো বাজিয়ে গান করছিলেন। কী ভাষা তার, জানা নেই। কিন্তু সেই গোধূলিতে সূর্য যখন ভূমধ্যসাগরের নোনা জলে শেষ লালটুকুর বিনিময়ে লীন হয়ে যাচ্ছে, গানের শেষ কথার রেশটুকু বুকের মধ্যে ছুঁয়ে যাচ্ছিল— সরস্বতী।
স্পেনীয় দেবী সরস্বতীর রূপ আমার জানা ছিল না। কিন্তু সে দিন সেই দিগন্তবিস্তারী সমুদ্রে সুরে সুরে নাচ করছিলেন সুরের দেবী নিভৃতবাসিনী শ্বেতাঙ্গনা বাণী বীণাপাণিই। বোঝা গেল, সরস্বতী দেবীর সাত সমুদ্র তেরো নদী জুড়েই রাজ্যপাট। গ্রিসে যেমন তাঁর নাম এথিনা, রোমে মিনার্ভা, পলিনেশিয়ায় অনুলাপ, পার্সিয়ায় অনাহিতা, প্রাচীন ইজিপ্টে তাঁর নাম নিথ অথবা সেশত, পশ্চিম আফ্রিকাতে অরুণ্মিলা, আর্মেনিয়াতে আনাহিত, ক্যারিবিয়ান দ্বীপে পাপা লেগবা অথবা চিনে মঞ্জুশ্রী। এমন আরও বহু প্রাচীন সংষ্কৃতিতে তিনি বিরাজমান নিজ গুণে। কিন্তু, আমরা আজ শুধু লন্ডনের কথাই বলব।
ভগবতী ভারতী দেবী লন্ডনগামিনী প্রথম কবে হয়েছিলেন বলতে পারি না, তবে, এখন বেশ জমজমাটি ভাবেই বাঙালি ডায়াস্পোরা তাঁর পুজোয় মেতেছে। লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে— কথাটা আধুনিক যুগে আর কতটা সত্যি, বলা মুশকিল। কারণ, চোখ খুললেই ভূরি ভূরি উলট্পুরাণ দেখা যাবে। তবু, ছেলেপিলেকে এ ভাবে শুরুতে অন্তত বোঝাতে হয়। আর তাই সরস্বতী পুজো প্রধানত কুচোকাঁচাদেরই পুজো।
সরস্বতী পুজো প্রধানত কুচোকাঁচাদেরই পুজো।—নিজস্ব চিত্র
একদল শিশু আসে, তাদের ম্যাজিক স্লেট নিয়ে হাতেখড়ি দিতে। আমাদের ভূদেববাবু খুব যত্ন করে তাতে লিখে দেন অ-আ-ক-খ, সঙ্গে ইংরেজিতেও অক্ষর পরিচয় বাদ যায় না। কিন্তু সেই স্লেট কি মুছে যায়? তারা ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে...’ গানের সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা মেলে নাচে, ধীরে ধীরে রবি ঠাকুর, সুকুমার রায়, এমনকি কবীর সুমনও ছুঁয়ে যায় এই প্রজন্মকে। তার পর বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে তারা ডাক্তার-উকিল-অর্থনীতিবিদ হয়, কিংবা অন্য কিছু করে— মা সরস্বতী তাদের ছুঁয়ে রাখেন সব সময়। ছোটবেলার ম্যাজিক স্লেটটা এ ভাবেই বড় থেকে বড় হয়ে যায়। আমাদের বাঙালি ডায়াস্পোরা বাড়তে থাকে।
উপোস করে পুজোয় অঞ্জলি তো দিতেই হয়, একেবারে কুচোদের জন্য থাকে হাতেখড়ির ব্যবস্থা।—নিজস্ব চিত্র
ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশনের তেমনই এ বার নবম বর্ষ— অনেক নতুন মানুষ এসেছে, কচিকাঁচাগুলো বড় হয়েছে, আবার নতুন বাচ্চা এসেছে, হেসেছে-মেতেছে এ বারও। গান-নাচ-হৈহৈ-আড্ডা— বাদ নেই এ বারও। খাবার-দাবার কিন্তু মিস করার নয়, কারণ শেফ বিখ্যাত ভীরাস্বামী রেস্তরাঁর কিশোর দাস।
আরও পড়ুন: লড়াইয়ের ভিডিয়ো ভাইরাল, দেখুন কে জিতল
ক্রয়ডনের খুব দূরে নয় স্যোয়ানলি। কেন্ট নামের কাউন্টিতে অ্যাশ, সিকামোর, ওক গাছের সবুজে ভরা ছোট্ট ইংলিশ গ্রাম, এখানে আশির দশকের মাঝামাঝি ‘ইউকে হিন্দু কালচারাল অ্যাসোসিয়েশান’ শুরু হয় সেখানকার বাঙালিদের নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলার উৎসব পালন করা। প্রথম প্রথম তা কিছু পরিবারের মধ্যে সীমায়িত থাকলেও নব্বইয়ের দশকে প্রথম কেন্ট শহরের মটিংহ্যামে প্রথম বারোয়ারি পুজো শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা হয়ে দাঁড়ায় পুরোপুরি বারোয়ারি পুজো। গ্লোবালাইজেশনের জন্য বাঙালি পরিবারের সংখ্যা এখন অনায়াসে ২২ থেকে বেড়ে ৮২ হয়েছে। আশপাশের বেক্সলিহিথ, ডার্টফোর্ড, অরফিংটন, সিডকাপের বাঙালিরাও যোগ দিয়েছে। ফেসটাইমে অঞ্জলিও দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন: ন’তলা থেকে পড়ে গিয়ে গা ঝেড়ে হাঁটা দিলেন মহিলা! উচ্চতায় যাঁদের ভয় তাঁদের জন্য নয় এই ভিডিয়ো
শুধু কুল খাওয়া যায় না। তবে তাতে কী? এখানে ইন্ডিয়ান বা ক্যারিবিয়ান মুদির দোকানে দিব্বি ‘কুলের কাছাকাছি’ পাওয়া যায়। তাই সব বাধাবিপত্তি উড়িয়ে দিয়ে সরস্বতী, দুর্গা, কালী— সব রকমের পুজোই এখন এখানে হয়। ২৬ জানুয়ারি সকাল থেকে হৈহৈ করে শুরু স্যোয়ানলি টাউন হলের আলেকসান্দ্রা স্যুটে শুরু বাঙালির ভ্যালেন্টাইন। উপোস করে পুজোয় অঞ্জলি তো দিতেই হয়, একেবারে কুচোদের জন্য থাকে হাতেখড়ির ব্যবস্থা।
কিন্তু তার পর? পেটপুজোর ব্যবস্থা তো করে রাখতেই হবে। তাই সকালের ভোগে গরমাগরম খিচুড়ি, লাবড়া আর চাটনি। বিকেলে স্থানীয় শিল্পীরা গান-নাচ-আবৃত্তি-নাটকে মাতিয়ে দেয় সকলকে। ছিল রিদম অব লাইফের নাচ। রবিছন্দ নাচের দল কত্থক নৃত্যে প্রনাম জানায় সরস্বতীকে। কিন্তু তার সঙ্গে মনোহারী শাড়ি গয়না বেলোয়ারি চুড়ির মেলা না বসলে হয়! নাই বা হল স্কুলের মাঠ! বিশাল হলঘরে বসেছিল দোকানদানি। ভোগে ছিল লুচির সঙ্গে ঝাল ঝাল আলুরদম। মিষ্টি পুরাণের ঘরে তৈরি বাঙালি মিষ্টি। ছিল পুরনো মিউজিক সিডি আর বই বিক্রির দোকান। বাড়ি বোঝাই এত বই, না পারা যায় রাখতে, না পারা যায় ফেলতে। এখানে কলেজ স্ট্রিটের মতো দোকান কিছু আছে ঠিকই, নিদেনপক্ষে অ্যামাজন বা ইবেতেও বিক্রি করা যায়— কিন্তু সরস্বতী বিদ্যার দেবী, তাই বই বা গানের সিডি থেকে কিছু পয়সা এলে তা যদি চ্যারিটিতে দেওয়া হয় মন্দ কী?