পাওলো ও লার্সিয়ো
মাসখানেক আগে ব্রাজিলের সরকারি দফতরে একটা ভিডিয়ো কল এসেছিল— ‘‘সাহায্য চাই। ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।’’
ফোনটা এসেছিল আমাজনের আদিবাসী ‘প্রহরীদের’ থেকে। জানিয়েছিল, জঙ্গল কেটে সাফ করে দিচ্ছে চোরাচালানকারীরা। প্রতিরোধ করলেই খুন করার হুমকি আসছে।
আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। খুন করা হয়েছে আমাজনের এক ‘প্রহরী’কে। ‘ব্রাজিলিয়ান ইন্ডিজেনাস পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’-এর তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, মারানহাও প্রদেশের ভিতরে জঙ্গলের গভীরে আরারিবোয়া এলাকায় গুলি করে খুন করা হয়েছে পাওলো পাওলিনো গুয়াজাজারাকে। লার্সিয়ো গুয়াজাজারা নামে আরও এক আদিবাসীকে গুলি করেছে কাঠ চোরাচালানকারীরা। তিনি হাসপাতালে ভর্তি। দুষ্কৃতীদের মধ্যেও এক জনের খোঁজ নেই। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর অতি-দক্ষিণপন্থী আইনমন্ত্রী সের্গিয়ো মোরো জানিয়েছেন, পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। আশ্বাস দিয়েছেন, অপরাধীদের খুঁজে বার করতে কোনও খামতি রাখা হবে না।
পাওলো ও লার্সিয়ো দু’জনেই আমাজনের আদি বাসিন্দা। জঙ্গলের কাঠচুরি রুখতে ২০১২ সালে তৈরি হয় ‘গার্ডিয়ানস অব দ্য ফরেস্ট’। সেই অভিভাবক দলের সদস্য ছিলেন এই দু’জনেই। জঙ্গলে অস্ত্র চোরাচালান, কাঠ-চুরি, বাইরের লোকের আনাগোনা রোখার দায়িত্ব এই রক্ষীদের। ফলে কালে কালে অনেক শত্রুই তৈরি হয়েছে তাঁদের। গত কয়েক বছরে মারানহাওয়ের অভিভাবকদের অনেকেই খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আরারিবোয়াতেই তিন জন।
মারানহাওয়ের আদিবাসী রক্ষা মিশনারি কাউন্সিলের অন্যতম কর্তা গিল্ডেরল্যান রডরিগস জানিয়েছেন, নিহত পাওলোকে একাধিক বার খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
তাঁর কথায়, ‘‘যারা জঙ্গলে লুটতরাজ চালাচ্ছে, পাওলোদের জন্য তাঁদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, খুনিরা আশপাশের গ্রামেরই বাসিন্দা। বিনা অনুমতিতে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে তারা। রডরিগসের কথায়, ‘‘আরও প্রাণ যাতে না যায়, দ্রুত আইনি পদক্ষেপ করা দরকার।’’
মারানহাওয়ে ৪,১৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে আরারিবোয়া অরণ্যে ৫৩০০ আদিবাসী থাকেন। সকলেই প্রায় ‘গুয়াজাজারা’ ও ‘আওয়া’ গোষ্ঠীর মানুষ। এর মধ্যে ‘আওয়া’রা পৃথিবীর সব চেয়ে বিপন্ন প্রজাতির মানুষ। মারানহাওয়ে আমাজনের বৃষ্টিবনানীর গভীরে এঁদের দেখা মেলে।
কাজের সূত্রে পাওলোর সঙ্গে পরিচয় ছিল গবেষক সারা শেনকারের। তাঁর কথায়, ‘‘সমুদ্রের মাঝে এক টুকরো দ্বীপ। দীর্ঘ এলাকা জুড়ে গাছ কেটে ফেলার পরে আরারিবোয়ার অংশটুকু এখনও সবুজ রয়েছে। পথের কাঁটা সরাতে পাওলোকে খুন যে করা হবে, তা আঁচ করা হয়েছিল।’’ পাওলো নিজেই সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের বলেছিলেন: ‘‘গাছ কাটা দেখে পাগলের মতো রাগ হয়। ওই লোকগুলো মনে করে, ওরা এখানে আসতেই পারে, আমাদের ঘরে। আমরা মানব না। আমরা ওদের ঘরে ঢুকে চুরি-ডাকাতি করছি না। করছি কি? আমার রক্ত ফুটছে। খুব রাগ হচ্ছে।’’ এ বছর জুন মাসেই আরারিবোয়ার প্রহরীদের নেতা ভিডিয়ো কলে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। জঙ্গলের রক্ষাকর্তা ব্রাজিল সরকারই। যদিও অভিযোগ, সরকার শুধুমাত্র দর্শক।
এ বছরের শুরুতে বলসোনারো প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে, এই ধরনের হত্যার ঘটনা আরও বেড়েছে। একটি নজরদারি সংস্থার দাবি, অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মারানহাওয়ে অন্তত ১৫৭ জন আদিবাসী নিহত হয়েছেন। মাস খানেক আগেও আমাজ়নের গভীরে আদিবাসীদের উপরে দুষ্কৃতীদের গুলি চালানোর কথা শোনা গিয়েছিল। সে সময়ে অভিযোগ ওঠে, আমাজ়নে খননকাজ চালানোর অনুমতি দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। আর তাতে দামি পাথরের লোভে অনুপ্রবেশের ঘটনা বাড়ছে। অপরাধ বাড়ছে। বিপন্নপ্রায় জঙ্গলের বাসিন্দারা। কিন্তু বলসোনারোর কথায়, ‘‘অত বড় জঙ্গল, আর ওই ক’টা মানুষ তো থাকে!’’
তবু সরকারের কাছে জঙ্গলের নিরীহ বাসিন্দাদের আর্তি, ‘‘আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা নিজেদের ঘর বাঁচাতে চাই, প্রতিরোধ করতে চাই।’’