প্রতীকী ছবি
বাড়িতে ছোট্ট অতিথি আসছে শুনেই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল ক্রিস জুংয়ের। তার পর কয়েকটা মাস একরাশ দুশ্চিন্তার। সঙ্গে অবশ্য অনেকখানি আনন্দও। ২০১৭-য় ফুটফুটে একটি মেয়ে হল ক্রিসের। বাবা কিন্তু তখনও কী যেন এক উত্তেজনায় ছটফট করছেন! কারণটা বোঝা গেল মাস কয়েকের মধ্যেই। আগে থেকেই সবটা ছকে নেওয়া ছিল ক্রিসের। সদ্যোজাতের লালা নিয়ে বাবা তাই এক দিন সকাল-সকাল ছুটলেন অফিসে। তার পর সেই লালা টেস্টটিউব-বন্দি করে ফের উদ্বেগের প্রহর গোনা। মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার কিংবা ডাকসাইটে উকিল হবে— এমনটাই চেয়েছিলেন বাবা। কিন্তু মেয়ের আদৌ সেই এলেম আছে কি না, তা জানতে নিজেরই ‘জিন ডিসকভারি’ অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে রইলেন কোম্পানির সিইও ক্রিস। এত দিন অন্যের সন্তানের ‘কপাল’ দেখে দিয়েছেন, এ বার নিজের পালা।
খবর এলও যথাসময়ে। ডিএনএ-রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল— এ মেয়ে নির্ঘাৎ গানবাজনা, অঙ্ক আর খেলাধুলোয় চৌখস হবে। কিন্তু ওই সাল-তারিখ-সমীকরণ কিংবা বিজ্ঞানের আর সব খুঁটিনাটি মনে রাখাটা একটু চাপের হয়ে যাবে। মুহূর্তের জন্য থমকালেন বাবা। তার পরেই মতি বদল— ‘‘না-ই বা হল ডাক্তার, মেয়ের যাতে মারকাটারি কিছু করার সুযোগ রয়েছে, এ বার তাতেই জোর দেব।’’
হংকংয়ে ‘কেনাকাটার স্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত জিম সা জ়ুই-এর ব্যস্ত রাস্তায় চুটিয়ে ব্যবসা করে চলেছে ক্রিসদের জিন-যাচাইয়ের অফিস। খোদ সিইও সাহেবই জানালেন, তাঁদের ক্লায়েন্টের একটা বড় অংশ আসে ‘মেনল্যান্ড চায়না’ থেকে। দুনিয়া জুড়ে যা প্রতিযোগিতার বাজার! তাই টেস্টটিউবে সদ্যোজাতের লালা পাঠিয়ে অনেক মা-বাবাই ইদানীং দুরুদুরু বুকে বসে থাকেন এই অফিসের ওয়েটিং হলে।
ক্রিসই বললেন ‘হেলিকপ্টার পেরেন্টিং’-এর কথা। মানে, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা অতি-মাত্রায় সচেতন। অনেকেই আগে থেকে সবটা গুছিয়ে রাখতে চান। সন্তান কিসে দড়, আর কিসে কমজোরি, বুঝে নিতে চান যাঁরা— ক্রিস জানালেন, তাঁরাই ভিড় জমাচ্ছেন ‘জিন ডিসকভারি’ অফিসে। গ্লোবাল মার্কেট ইনসাইটস ইনকর্পোরেশনের সমীক্ষা বলছে, জিন-যাচাইয়ের হিড়িক বিশ্বের বহু প্রান্তে শুরু হলেও, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে চিনই। গত বছর পর্যন্ত যেখানে জিন ডিসকভারির মতো সংস্থা ৪ কোটি ডলারের ব্যবসা করেছিল, ২০২৫-এর মধ্যে তা ১৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। জিন যাচাইয়ের খরচ কেমন? জিন ডিসকভারি সংস্থার ওয়েবসাইটই বলছে, মাত্র ৫৭৫ ডলার! এর মধ্যে ‘আই-জিনিয়াস’ প্যাকেজ, যা শিশুর ‘প্রতিভা’ বলবে— সেটাও ধরা আছে।
শুধু ল্যাবে গিয়ে পরীক্ষা করানো নয়। চিনে বিক্রি বাড়ছে ‘ডিএনএ টেস্ট কিট’-এরও। বেজিংয়ের একটি বাণিজ্য-বিশ্লেষক সংস্থার দাবি, গত বছর যে কিট ১৫ লক্ষ বিক্রি হয়েছিল, ২০২২-এর মধ্যে তা ৬ কোটির লক্ষ্যমাত্রা ছোঁবে। ‘জিন ডিসকভারি’-র মতো ডজনখানেক সংস্থা নিয়মিত সদ্যোজাতের জিন-যাচাই করে চলেছে বলে একাধিক সমীক্ষার দাবি।
ব্যবসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিতর্কও। জিন-যাচাই সংস্থাগুলির দাবি, সদ্যোজাতের ডিএনএ পরীক্ষা করে তারা বলে দিতে পারে, বড় হয়ে তার স্মরণশক্তি কেমন হবে, কতখানি মানসিক চাপ নিতে সক্ষম হবে কিংবা আদৌ নেতৃত্ব দিতে পারবে কি না। সমালোচকেরা কিন্তু বলছেন, এ সব একেবারেই বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। ভাগ্যগণনার মতো বুজরুকি চলছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন-বিশেষজ্ঞ গিল ম্যাকভিন যেমন বলেই দিলেন, ‘‘সন্তান বড় হয়ে কী বা কেমন হবে, জিন দেখে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি ম্যাকভিন ‘বিগ ডেটা ইনস্টিটিউটের’ ডিরেক্টরও। যে সংস্থার কাজই হল, স্বাস্থ্যে ঝুঁকি এড়াতে ডিএনএ নিয়ে গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ।
প্রশ্নের মুখে পড়ে ‘জিন ডিসকভারি’ সংস্থার কর্মকর্তারা এখন বলছেন, তাঁরা শুধু সদ্যোজাতের মধ্যে থাকা কয়েকটি সম্ভাবনার সূত্র ধরিয়ে দেন। সঙ্গে কোনও শারীরিক ঝুঁকি থাকলে, তা-ও জানিয়ে দেন। ‘বিস্ময়বালক’ কিংবা ‘বালিকার’ খোঁজে তা হলে এত হুড়োহুড়ি কেন চিনে? জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিনের কড়া আইন ২০১৬-য় নাকচ হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চিনে অনেকেরই একটি সন্তান এবং তাঁরা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতি-মাত্রায় সচেতন।
‘সুপার মাঙ্কি’ তৈরি হোক, বা জিন সম্পাদনা করে বা পাল্টে ‘উন্নত’ মানবশিশুর জন্ম দেওয়া— চিন ইতিমধ্যেই একাধিক বার বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে। এ বার প্রশ্নের মুখে তাদের জিন-পরীক্ষায় ঝাঁপ। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বলছেন, শুধু ডিএনএ বিশ্লেষণ এক জন মানুষের ভবিষ্যৎ বাতলাতে পারে না। কিংবা কোনও একটি সুনির্দিষ্ট জিন থাকা মানেই যে ওই শিশু পরবর্তী কালে অ্যাথলিট কিংবা ডাক্তার হবে, এটা বলা যায় না। এ নিয়ে পরীক্ষাও হয়েছে। চিনের ‘হেলিকপ্টার’ বাবা-মায়েরা তবু নাছোড়বান্দাই।
জিন-যাচাইয়ের চল রয়েছে ইউরোপ আমেরিকাতেও। কিন্তু একাধিক রিপোর্ট বলছে, সেখানে এই পরীক্ষা করানো হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুধু স্বাস্থ্য খাতে ঝুঁকির কথা জানতে। জিন পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর সুস্থতা, শারীরিক সক্ষমতা কিংবা প্রতিভা অন্বেষণকারী সংস্থাগুলির উপর সেই অর্থে আমেরিকার ফুড ও ড্রাগ নিয়ন্ত্রক বিভাগের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু কোনও সংস্থা যদি শিশুর ক্যানসার সম্ভাবনার কথা জানায়, তার উপর নজর রাখা হয় নিয়মিত। অথচ চিনে কোনও রকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ‘প্রতিভা-তল্লাশির’ ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে।