চোখ, কিন্তু চোখ নয়। জনমানবহীন মরুভূমি জুড়ে বিস্তৃত এক গহ্বর। পৃথিবীর অন্যতম এই অমীমাংসিত রহস্যের পরিচয় ‘আই অব দ্য সহারা’।
খালি চোখে এর অস্তিত্ব ধরা পড়েনি। ফলে কয়েক হাজার বছর ধরে এই ভৌগোলিক সৃষ্টি প্রকাশ্যে থেকেও রয়ে গিয়েছিল সবার অগোচরে। কারণ উপর থেকে না দেখলে অর্থাৎ ‘বার্ডস আই ভিউ’ না থাকলে এই ‘চোখ’ রয়ে যেত মানুষের নজরের বাইরেই।
ফলে প্রথমবারের জন্য সহারা মরুর চোখ গোচরে এল যখন মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিল। তারপরেও বিজ্ঞানীরা বুঝতেই পারেননি সহারা মরুর প্রান্তরে এটা কী ছড়িয়ে আছে। এত বছর পরে দীর্ঘ গবেষণার পরেও এর সৃষ্টিরহস্য সম্পূর্ণ ধরা পড়েনি।
পশ্চিম সহারা মরুভূমির যে অংশ মরিতানিয়া দেশের অন্তর্গত, সেখানেই রয়েছে এই ‘চোখ’। পোশাকি পরিচয় ‘রিশাত স্ট্রাকচার’ বা ‘কালব আর রিশাত’।
৪০ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল ব্যাসের উপবৃত্তাকার এই গহ্বরের অস্তিত্ব প্রথম ধরা পড়ে আমেরিকার মহাকাশ অভিযান ‘জেমিনি ফোর’-এ। ১৯৬৫ সালে এই অভিযানে চারদিন ধরে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করেছিলেন মহাকাশচারীরা।
তাঁদের বলা হয়েছিল, উপর থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের ছবি পাঠাতে। তাঁদের পাঠানো ছবিতে ধরা পড়ে সহারা মরুর চোখ। ভূবিজ্ঞানীদের প্রাথমিক ধারণা হয়, এই মরুচোখ আসলে ‘ইমপ্যাক্ট ক্রেটার’।
পৃথিবী-সহ সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহের ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন কারণে গহ্বর সৃষ্টি হয়। উল্কাপাত, ধূমকেতুর আঘাত তার অন্যতম কারণ। আবার তীব্র ভূমিকম্প, ভূত্বকের সঙ্কোচন-প্রসারণ বা ভূঅভ্যন্তরস্থ প্লেটের সংঘর্ষের ফলেও গহ্বর তৈরি হয়। মূলত এই দ্বিতীয় কারণে তৈরি গহ্বরকেই বলা হয় ‘ইমপ্যাক্ট ক্রেটার’।
পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূবিজ্ঞানীদের কাছে ইমপ্যাক্ট ক্রেটার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সহারা মরুর ‘চোখ’-এ কোনও গলিত শিলার চিহ্ন পাননি বিজ্ঞানী। ফলে আধুনিক গবেষণা একে নিছক ‘ইমপ্যাক্ট ক্রেটার’ বলতে নারাজ। বরং এর পিছনে আছে আরও জটিল ও বিস্তৃত তত্ত্ব।
এই গহ্বরের যে মূল বেষ্টনী, তা হল পৃথিবীর প্রাচীনতম ভূভাগের ক্ষয়ে যাওয়া অংশের চিহ্ন। আধুনিক গবেষকদের ধারণা, সহারার চোখের সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১০০০ কোটি বছরেরও আগে।
অর্থাৎ যে সময় পৃথিবীর কোনও মহাদেশ আলাদাই হয়নি। অবিভক্ত মহাদেশ হিসেবে ছিল ‘প্যানজিয়া’। ভূগর্ভস্থ পাত আন্দোলিত (প্লেটটেকটনিক্স মতবাদের) হওয়ার জেরে কয়েক টুকরো অংশে বিভক্ত হয়ে যায় প্যানজিয়া। দু’টুকরো হয়ে দু’দিকে চলে যায় আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা।
গলিত শিলা প্রবল তাপে ও চাপে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু পুরোপুরি বার হতে পারে না। ফলে তা উঁচু হয়ে গম্বুজের আকার নেয়। হাল্কা করে বলতে গেলে, ত্বকের ভিতরে ময়লা বার না হয়ে যেমন ব্রণ তৈরি হয়, অনেকটা সে রকমই।
এই গম্বুজকেই বলা হয় ‘ডোম অব লেয়ার্স’। যা নাকি পৃথিবীর ভূভাগের আদি রূপ। প্যানজিয়া বিভক্ত হওয়ার পরপরই আবার তীব্র ভূমিকম্প। এর ফলেই বিশাল অংশ ধসে গিয়ে সৃষ্টি হয় গহ্বরের। এরপর কোটি কোটি বছর ধরে আবহবিকারের ফলে ক্রমাগত ক্ষয় ও সঞ্চয় প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে ক্রেটারের বর্তমান রূপ।
এই গহ্বর জুড়ে শিরা উপশিরার মতো বিস্তৃত স্তর আসলে কয়েক কোটি বছরের আবহবিকারের চিহ্ন। বহু রকমের শিলার উপস্থিতি এই গহ্বরকে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছে করে তুলেছে আকর্ষক।
মহাকাশচারীদের কাছেও এই গহ্বর-চোখ সহারার আদিগন্ত বালির মধ্যে ‘চোখের আরাম’। একঘেয়েমি কাটানো ছাড়াও এটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্কও বটে। অনেকে একে প্লেটো বর্ণিত ‘আটলান্টিস’ নগরীর সঙ্গে জুড়তে চাইলেও গবেষণা গুরুত্ব দেয় গহ্বরের ভৌগোলিক ব্যাখ্যাকেই।
তবে এই ভৌগোলিক ব্যাখ্যাও সর্বজনগ্রাহ্য নয়। অনেক বিজ্ঞানীই এর পিছনে অন্য রহস্য রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। তাই রহস্যময় চোখ নিয়ে গবেষণাও এখনও চলছে। (ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া ও আই স্টক)