বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজ়েশন বা হু) আর থাকবে না আমেরিকা। কুর্সিতে বসেই সে কথা ঘোষণা করলেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে চিনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তিনি, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের একাংশের।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। অনুষ্ঠান শেষে প্রায় ১০০টি নতুন নির্দেশনামায় সই করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল হু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার সংক্রান্ত আদেশনামা।
কেন হঠাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে আসার প্রয়োজন হল, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন আমেরিকার নতুন বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের যুক্তি, ‘‘ওয়াশিংটনের থেকে বছরে ৫০ কোটি ডলার অনুদান পায় হু। আর চিন দেয় মাত্র ৩.৯ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বাস করেন ড্রাগনভূমিতে। আর তাই এ ব্যাপারে বেজিঙের খরচের অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত।’’
হু থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তকে একেবারেই অনৈতিক বা অন্যায্য বলে মানতে নারাজ ট্রাম্প। যদিও বিশেষজ্ঞদের দাবি, তাঁর এ হেন সিদ্ধান্তের বীজ লুকিয়ে রয়েছে কোভিড অতিমারির মধ্যে। সূত্রের খবর, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট মনে করেন বেজিঙের হয়ে কাজ করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর সেটা কখনওই বরদাস্ত করবেন না তিনি।
২০১৯ সালে চিনের উহান থেকে ধীরে ধীরে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। ঠিক তার পরের বছর পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ভাইরাসের আক্রমণে আমেরিকা-সহ বিশ্ব জু়ড়ে প্রাণ হারান লাখ লাখ নিরীহ নাগরিক। ওই মৃত্যুমিছিলের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দায়ী করেছিলেন ট্রাম্প।
২০২০ সালে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ট্রাম্প বলেন, চিনা ভাইরাস সম্পর্কে সময় থাকতে সঠিক তথ্য দেয়নি হু। ফলে বিপুল প্রাণহানি আটকাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। ওই বছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আইনের জাঁতাকলে আটকে যায় তাঁর পরিকল্পনা।
রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউনাইটেড নেশনস অর্গানাইজ়েশন বা ইউএনও) অধীনস্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংগঠন হল হু। সারা বিশ্বে এর ১৫০-এর বেশি ফিল্ড কার্যালয় রয়েছে। বিভিন্ন মারণব্যাধির চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণার কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে এই আন্তর্জাতিক সংস্থার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দফতর রয়েছে সুইৎজ়ারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। এর জন্মের তারিখটি হল ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল।
মূলত অনুদানের উপর ভর করে গত ৭৬ বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে হু। প্রতিষ্ঠান চালানোর অর্থ দু’ভাবে পায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রথমত, হু-এর জন্য টাকা দেয় রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্তত ২০০টি সদস্য রাষ্ট্র। এই অনুদানের পরিমাণ কেমন হবে, তা ঠিক করে সংশ্লিষ্ট দেশটির সরকার।
এ ছাড়া জনসংখ্যা এবং আর্থিক সঙ্গতির উপর নির্ভর করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য কিছু রাষ্ট্রের থেকে বিশেষ অনুদান নিয়ে থাকে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর জন্য প্রতি দু’বছর অন্তর ইউএনওর ভিতরে চলে ভোটাভুটি। বিশেষ অনুদানের পুরোটাই চলে যায় হু-এর কোষাগারে। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনটির ওই টাকা ইচ্ছামতো খরচ করার অধিকার রয়েছে।
হু-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে সর্বাধিক বিশেষ অনুদান আমেরিকা এবং চিনের উপর ধার্য করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ২৬.৪০ কোটি ডলার এবং বেজিঙের থেকে ১৮.১০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা রয়েছে তাদের। এই অর্থের সিংহভাগই দিয়ে দিয়েছে বিশ্বের দুই মহাশক্তিধর দেশ।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কোনও দেশ স্বেচ্ছায় অনুদান দিতে পারে। আর সেখানে চিনের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে আমেরিকা। হু জানিয়েছে, বছরে প্রায় ৪৫ কোটি ডলার স্বেচ্ছা-অনুদান দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বেজিঙের দেওয়া স্বেচ্ছা-অনুদানের অঙ্ক মাত্র ২০ লক্ষ ডলার।
২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে হু-এর বাজেটের ১০ শতাংশই দিয়েছে আমেরিকা। অন্য দিকে চিনের থেকে এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি পেয়েছে বাজেটের মাত্র তিন শতাংশ টাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য চলতি আর্থিক বছরে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে প্রায় ৭১ কোটি ডলার। সেখানে মাত্র ১৮ কোটি ডলার দিয়েছে বেজিং।
অনুদানের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য নিয়েই ঘোর আপত্তি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। সূত্রের খবর, ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন অনুদান বাড়িয়ে হু-এর বাজেটের আট শতাংশ খরচ চিনকে বহন করতে হবে। কোনও আন্তর্জাতিক সংগঠনের খরচের ভার একা আমেরিকার কাঁধে থাকতে পারে না।
এই ইস্যুতে ইতিমধ্যেই পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আন্তর্জাতিক সংগঠনটির জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ওয়াশিংটন তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে বলে আমরা যথেষ্ট আশাবাদী। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে আমরা জড়িয়ে রয়েছি। এর গুরুত্ব নিশ্চয়ই বুঝবে আমেরিকার প্রশাসন।’’
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে নিয়ে মুখ খুলেছেন লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান্ড্রু হার্মার। তাঁর কথায়, ‘‘আমেরিকা পুরোপুরি হু-এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলিতে তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না। কিন্তু নিম্ন এবং মধ্য আয়ের রাষ্ট্রগুলির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।’’
প্রায় একই কথা বলেছেন মালয়েশিয়ার কুয়ালা লামপুরে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেল্থের জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাককয়। তিনি বলেছেন, ‘‘আফ্রিকার গরিব দেশগুলির পক্ষে ভাইরাসজনিত রোগ নিয়ে গবেষণা চালানো একরকম অসম্ভব। হু-এর আর্থিক সঙ্গতি কমলে সেখানে স্বাস্থ্য সহযোগিতা বন্ধ করতে পারে এই সংগঠন।’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আমেরিকার সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি বেজিং। শুধু তা-ই নয়, আমন্ত্রণ পেয়েও ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে যাননি চিনের চেয়ারম্যান তথা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ফলে আগামী দিনে ড্রাগনভূমি হু-এর জন্য অনুদান বৃদ্ধি করবে, এমন ভাবনা কষ্টকল্পিত।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পূর্ব ইউরোপে চলেছে রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধ। এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধশালী মহাদেশটিতে রয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত অস্থিরতা। ফলে সেখানকার কোনও দেশের স্বেচ্ছা-অনুদান বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
আমেরিকাকে ফের এক বার ‘মহান দেশে’ পরিণত করতে চিনা পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে শপথের পর সেই সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ তারই আগাম ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের থেকে টাকা পাওয়া বন্ধ হলে আর্থিক দিক থেকে বড় ধাক্কা খাবে হু। সে ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটি কার্যালয় বন্ধ করতে পারে এই সংগঠন। দ্বিতীয়ত, সব ধরনের রোগের বদলে বিশেষ কয়েকটি নিয়ে গবেষণায় জোর দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।