এক দিকে তুবড়ে গিয়ে অন্য দিকে তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছে করোটি। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে গোপন রহস্য। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রায় ১৬০০ বছরের প্রাচীন এই সূচালো খুলি ইতিহাসের এক অজানা দিক প্রকাশ করবে। কারণ গবেষণা বলছে, জীবদ্দশায় ইচ্ছাকৃত ভাবে বিকৃত হয়েছিল করোটি। এর সঙ্গেই জুড়ে আছে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে ইউরোপ-সহ বিশ্ব জুড়ে মাইগ্রেশনের ইতিবৃত্ত।
৩০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ। অতীতের ক্ষমতাশালী রোমান সাম্রাজ্যের শক্তি শেষ। ইউরোপ জুড়ে বর্বর যাযাবার জাতি হুন ও গথদের মধ্যে চলছে তীব্র রক্তক্ষয়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সেই যুগের তিনটি করোটি উদ্ধার হয়েছে পূর্ব ক্রোয়েশিয়ার একটি পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে। করোটি দেখে অনুমান, তিন জনই মারা গিয়েছিল কিশোর বয়সে। ৪১৫ থেকে ৫৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
ডিএনএ পরীক্ষায় দাবি, তিন কিশোরকে একই জায়গায় সমাধিস্থ করা হলেও তাদের জিনগত উৎস আলাদা। অর্থাৎ তাদের পূর্বপুরুষরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে থাকতে শুরু করেছিল ইউরোপে। একটি খুলিতে কোনও বিকৃতির চিহ্ন নেই। তার পূর্বপুরুষরা পশ্চিম ইউরেশিয়ার বলে জানা গিয়েছে।
বাকি দু’টি খুলিতেই স্কাল মডিফিকেশনের ছাপ স্পষ্ট। অর্থাৎ বলপ্রয়োগ করে বিকৃত করা হয়েছিল শিশুর বৃদ্ধি। সে দু’টির একটির উৎস আজকের চিন, জাপান। অন্যটির পূর্বপুরুষরা পূর্ব এশিয়ার।
আর্টিফিশিয়াল ক্র্যানিয়াল ডিফর্মেশন বা এসিডি হল শিশুর মাথা শক্ত করে বেঁধে রাখা। যাতে তার করোটির গঠন বিকৃত হয়। বডি মডিফিকেশনের এই রীতি পৃথিবী জুড়ে চলে আসছে নব্য প্রস্তর যুগ থেকে। ইউরোপে কৃষ্ণসাগরের কাছাকাছি দেশগুলোয় এই রীতি শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠেছিল পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে। সপ্তম শতকে অবলুপ্ত হয়ে যায়।
এসিডি স্কাল বা ইচ্ছাকৃত ভাবে বিকৃত করোটি এখনও অবধি ক্রোয়েশিয়া থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে অন্তত বারোটি। গবেষকদের একাংশের দাবি, এই আবিষ্কার একটি পুরনো দাবিকেই ফের জোরালো করে তুলছে। তা হল, হুনরাই এই রীতি মধ্য ইউরোপে এনেছিল ও জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে তারপর তাতে লীন হয়েছে দুর্ধর্ষ হুন জাতি। কিন্তু এই বর্বর যাযাবর জাতির উৎস কোথায় ছিল? তা নিয়ে এখনও ভিন্নমত ইতিহাসবিদরা। এতদিন অবধি মেনে নেওয়া হত, তারা এসেছিল পূর্ব এশিয়া থেকে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার এই আবিষ্কারে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হুনদের এই শাখা ইউরোপে এসেছিল কৃষ্ণসাগরের উত্তর থেকে।
তবে হুনরাই একমাত্র এই রীতির ধারক ও বাহক ছিল, তা মানতে রাজি নন অনেক বিশেষজ্ঞই। তাঁদের দাবি, এই রীতি এসেছিল ইউরোপীয় স্তেপভূমি থেকে। হুনরা তাতে নিজেদের কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করেছিল হয়তো।
কিন্তু এই তিনটি খুলি কী করে একই জায়গায় এল, রহস্য আছে তা নিয়েও। ক্রোয়েশিয়ার হারমানোভ-এ, যেখানে এই করোটি উদ্ধার হয়েছে, সেখানে নব প্রস্তর যুগের নিদর্শন এর আগে বহু উদ্ধার হয়েছে। তখন এখানে বড় বসতি ছিল, তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু মাইগ্রেশনের সমসাময়িক বসতির চিহ্ন ছিল না। তাই এই তিন কিশোরের বাস অন্যত্র ছিল বলেই অনুমান।
গবেষণায় দাবি, মৃত্যুর আগে তিন কিশোর একই খাবার খেয়েছে দীর্ঘ দিন। তারা থাকতও একই জায়গায়। তাদের কবর দেওয়া হয়েছিল ঘোড়া ও শূকরের হাড় সমেত। তবে অজ্ঞাত রয়ে গিয়েছে তাদের অকালমৃত্যুর কারণ। অনুমান, হয়তো তাদের বলি দেওয়া হয়েছিল। অথবা প্লেগের মতো কোনও মারণ মহামারীতে মৃত্যু হয়েছিল। বলপ্রয়োগ করে হত্যার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ইউরোপের অন্য অংশেও উদ্ধার হয়েছে এসিডি স্কাল বা বিকৃত খুলি। তাদের মধ্যে মহিলাদের করোটির অনুপাতই বেশি। এই বিষয়ে আরও গবেষণায় আরও নতুন নতুন তথ্য জানা যাবে বলে দাবি ইতিহাসবিদদের। কারণ, এই রীতি কারা ইউরোপে এনেছিল, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মাইগ্রেশনের অজানা তথ্য।
মানুষ দেশান্তরী হওয়ার জন্যই পৃথিবী জুড়ে বিকশিত হয়েছে সভ্যতা। মধ্যযুগীয় মাইগ্রেশন বা পরিযানের বড় প্রভাব আছে বিশ্বের পরবর্তী জনবিন্যাসে। মূলত হুন ও গথ যাযাবর গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত এই পরিযান নিয়ে অনেক তথ্যই এখনও অজানা। এসিডি স্কাল নিয়ে ক্রমাগত আধুনিক গবেষণা সেই অন্ধকারে আলো ফেলবে বলে বিশ্বাস ইতিহাসবিদদের।