তিন ঘণ্টা ধরে লাগাতার বিস্ফোরণ! একসঙ্গে ছ’টি নিশানায় হামলা। আর তাতে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল প্রায় গোটা শহর। ‘অবাধ্য’ ইউক্রেনকে শ্মশানে পরিণত করতে এ বার তুণের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মস্কোর সেই ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের তেজ কাঁপুনি ধরিয়েছে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে।
চলতি বছরের ২১ নভেম্বর ইউক্রেনীয় শহর ডেনিপ্রোতে ‘আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ (ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম) দিয়ে হামলা চালায় পুতিন ফৌজ। হাতিয়ারটির কোড নেম ‘ওরেশনিক’, রুশ ভাষায় যার অর্থ হ্যাজেল গাছ। প্রথম বার কোনও যুদ্ধে মস্কো আইসিবিএম ক্ষমতা দেখাল বলে জানা গিয়েছে।
‘অপারেশন ডেনিপ্রো’র কিছু ক্ষণের মধ্যেই টিভিতে ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘নতুন ধরনের প্রথাগত মাঝারি পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে (ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইআরবিএম) হামলা চালানো হয়েছে। শব্দের ১০ গুণ গতিতে (১০ ম্যাক) উড়ে গিয়ে সেটি লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে।’’
রুশ প্রেসিডেন্টের দাবি সত্যি হলে সেকেন্ডে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে ‘ওরেশনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র। আর তাই কোনও ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) পক্ষে একে চিহ্নিত করে মাঝ আকাশে ধ্বংস করা অসম্ভব, বলেছেন ক্রেমলিনের রাষ্ট্রপ্রধান।
অন্য দিকে, ইউক্রেনের ফৌজি গুপ্তচর বিভাগ ‘ওরেশনিক’কে নতুন ধরনের আইসিবিএম বলে উল্লেখ করেছে। তাদের দাবি, রাশিয়ার আস্ট্রাখান এলাকা থেকে এটিকে ছুড়েছে পুতিন ফৌজ, ডেনিপ্রো থেকে যার দূরত্ব প্রায় হাজার কিলোমিটার (৬২০ মাইল)। লক্ষ্যে আঘাত হানতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় নিয়েছে ‘ওরেশনিক’।
কিভের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, শব্দের চেয়ে ১১ গুণ গতিতে উড়ে এসে হামলা চালায় ওই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। মোট ছ’টি ওয়ারহেডে সজ্জিত ছিল ‘ওরেশনিক’। সেগুলির প্রতিটি থেকে আবার ডেনিপ্রোর উপর আছড়ে পড়ে ছ’টি করে বিস্ফোরক ভর্তি হাতিয়ার। ইউক্রেনীয় শহরকে ধূলিসাৎ করার ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে মস্কো।
দক্ষিণ-পশ্চিম ইউক্রেনের ডেনিপ্রোর শিল্পাঞ্চলীয় শহর হিসাবে পরিচিতি রয়েছে। এই এলাকাতেই রয়েছে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের একাধিক কারখানা। সেগুলিকে নিশ্চিহ্ন করতেই এই হামলা বলে মনে করা হচ্ছে। ‘ওরেশনিক’ তার ‘কাজ’ সাফল্যের সঙ্গেই শেষ করেছে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ইলিয়া ক্রামনিক জানিয়েছেন, সাধারণত অন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা তিন থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার হয়ে থাকে। তবে মস্কোর হাতে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের আইসিবিএমও রয়েছে। ‘ওরেশনিক’ মাঝারি পাল্লার হওয়ায় তা অনায়াসেই হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম।
দ্বিতীয়ত, এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম। যদিও ডেনিপ্রোয় সাধারণ বিস্ফোরক দিয়েই হামলা চালিয়েছে মস্কো। গতির নিরিখে অবশ্যই একে ‘হাইপারসনিক’ বলতে হবে। এর কারণ, শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে অনেক বেশিতে ছুটতে পারে ‘ওরেশনিক’।
তবে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ায় বার বার আলোচনার উঠে এসেছে পুতিনের এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’র গতি। বর্তমানে ইউক্রেন বাহিনী ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। গতির জোরে একে অনায়াসেই ‘ওরেশনিক’ মাত দেবে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্যাট্রিয়ট হাতে আসার পর ৮০ শতাংশ রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করে মাঝ আকাশেই ধ্বংস করতে পেরেছে কিভ। অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ ‘ওরেশনিক’কে রাশিয়ার তৈরি ‘আরএস-২৬ রুবেজ়’ আইসিবিএমের ধাঁচে তৈরি একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র বলে উল্লেখ করেছে।
রুশ সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘তাস’ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে মারণ ক্ষেপণাস্ত্র ‘রুবেজ়’ তৈরিতে হাত দেয় মস্কো। কিন্তু পরে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সেই প্রকল্পের কাজ স্থগিত করে ক্রেমলিন। এই সময় সীমার মধ্যে ‘অ্যাভানগার্ড’ নামের আর একটি হাতিয়ার তৈরির দিকে নজর দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
রাশিয়ার জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ইয়ান মাতভেয়েভ ‘টেলিগ্রাম’-এ লিখেছেন, ‘‘‘ওরেশনিক’-এর সম্ভবত দু’টি পর্যায় রয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি যথেষ্ট ভারী এবং ব্যয়বহুল।’’ বিশ্লেষকদের ধারণা, এই ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ইউরোপের দূরতম প্রান্তে হামলা চালাতে পারবে ‘বাদামি ভালুকের দেশ’।
তবে ‘ওরেশনিক’ দিয়ে আমেরিকায় আক্রমণ শানানো যাবে না বলেই মনে করছেন রুশ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ পাভেল পডভিগ। আবার এই ধরনের নতুন নতুন হাতিয়ারের হামলা যে ইউক্রেনে বজায় থাকবে, সেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ২০২২ সালে যুদ্ধের গোড়ার দিকে ‘কিনজ়েল’ নামের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল রুশ বায়ুসেনা।
আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে আমেরিকা। সেখানে ৫০০ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে রাজি হয়েছিল দুই দেশ। কিন্তু ২০১৯ সালে সেই চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসে মস্কো এবং ওয়াশিংটন।
গত ২২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘নেটো’ দেশগুলিকে নতুন করে হুমকি দেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তাঁর অস্ত্রাগারে দূরপাল্লার আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের যে কোনও অভাব নেই, ‘ওরেশনিক’ ব্যবহার করে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন পুতিন। প্রয়োজনে পশ্চিম ইউরোপে হামলা চালাতেও দ্বিধা করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের নীতিতেও (নিউক্লিয়ার ডকট্রিন) বড় বদল এনেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ফলে আণবিক হাতিয়ারবিহীন দেশেও পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগে মস্কোর কোনও বাধা নেই। তাঁর এই পদক্ষেপে ইউরোপ তথা দুনিয়া জুড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক বেড়েছে।
গত ১৯ নভেম্বর হাজারতম দিনে পা রাখে ইউক্রেন যুদ্ধ। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে পাওয়া ‘আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম’ (এটিএসিএমএস) দিয়ে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক এলাকায় হামলা চালায় জ়েলেনস্কির ফৌজ। ‘ওরেশনিক’ দিয়ে মস্কো তারই প্রত্যাঘাত হেনেছে বলে মনে করা হচ্ছে।