প্যালেস্টাইনি শিশুর সঙ্গে সৈয়দ সাইদ। গাজ়ায়। —নিজস্ব চিত্র।
প্রশ্ন: কী ভাবে শুরু হল এই যাত্রা?
উত্তর: দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয় আমি, জন্ম এ-দেশেই। নিউ ইয়র্কের স্টোনি ব্রুক মেডিক্যাল স্কুল অব মেডিসিন থেকে ডাক্তারি পাশ করেছি। পেশায় প্লাস্টিক সার্জন। স্ত্রী ও ছোট-ছোট তিন সন্তান নিয়ে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে ব্যস্ত জীবন।
প্রশ্ন: গাজ়ায় গিয়ে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াবেন, হঠাৎ এই চিন্তা মাথায় এল কী ভাবে?
উত্তর: দেখুন, মাসের পর মাস এই ভয়াবহ যুদ্ধ দেখছি আমরা। আমার মতো বহু মানুষের মনেই একটা অসহায়তা জমা হচ্ছিল। দানা বাঁধছিল প্রতিবাদও। এই সব দেখতে দেখতে আমাদের সহনশীলতার সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। এ দেশেই আমি বিক্ষোভ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছি, সংঘবদ্ধ ভাবে কংগ্রেস সদস্যদের ফোন করে সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে সেটাও যথেষ্ট মনে হয়নি। আমি সরাসরি পৌঁছতে চাইছিলাম, সরাসরি দাঁড়াতে চাইছিলাম আহত ও বিপর্যস্ত মানুষের পাশে। এই ইচ্ছে থেকেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘মেডগ্লোবাল’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। শুনেছিলাম, তাঁরা গাজ়ায় চিকিৎসক, শল্যচিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক পাঠাচ্ছেন।
প্রশ্ন: আগে এ ধরনের কোনও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে?
উত্তর: আমি এর আগে এই সংস্থাটির সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা এবং তানজ়ানিয়ায় মেডিক্যাল মিশনে গিয়েছি। তবে সেগুলি শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে। কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
গাজ়ায় যাওয়ার প্রথম সুযোগ আসে ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে। সবে সেটা বাতিল হয়ে যায়। তার পরে আবার সুযোগ আসে এপ্ৰিলে। তখনই আমাদের মেডিক্যাল টিম গাজ়ার উদ্দেশে যাত্রা করে। প্রথমে আমরা কায়রো পৌঁছই। আমাদের দলে মোট আট জন চিকিৎসক ছিলেন, কেউ ইন্টারনাল মেডিসিনের, কেউ জেনারেল সার্জন, কেউ বা অর্থোপেডিক সার্জন। চিকিৎসকদের মধ্যে তিন জন অস্ট্রেলিয়ার, দু’জন পাকিস্তানি। এক জন ভারতীয় ও আমাকে নিয়ে দু’জন আমেরিকা থেকে আসা চিকিৎসক ছিলেন। এসেছিলেন এক জন নার্সও।
কায়রোতে আমাদের সিকিয়োরিটি ব্রিফিং হয়ে যাওয়ার পরে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশনের চিকিৎসক দলের সঙ্গে রাফা সীমান্ত পেরিয়েগাজ়া পৌঁছই।
প্রশ্ন: ভয় করেনি?
উত্তর: চারদিকে বোমাবর্ষণ হচ্ছিল, তবু ভয় করেনি। বিশ্বাস ছিল, পৌঁছে যাব, কাজ করতে পারব। আমরা প্রথম পৌঁছই একটি সেফ হাউসে। গাজ়ার ‘সেফ জ়োনে’ ছিল সেই সেফ হাউস। সারা পৃথিবী থেকে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি সেখান থেকেই কাজ করে। প্রথমে আমি গাজ়া ইউরোপিয়ান হাসপাতলে কাজ শুরু করি। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয় যে, এক সপ্তাহ বাদে আমাকে তুলে নেওয়া হবে।
প্রশ্ন: থাকতেন কোথায়?
উত্তর: হাসপাতালের ঠিক লাগোয়া একটি বাড়িতে থাকতাম আমরা। এক একটি ঘরে চার থেকে ছ’জন ডাক্তার। আমরা স্থানীয় ডাক্তারদের সঙ্গেই থাকতাম। তাঁদের পরিবারেরা কিন্তু সবাই ঘরছাড়া, শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন।
প্রশ্ন: খাবার পেতেন?
উত্তর: দিনের মধ্যে এক বার। বাইরে থেকে আসা ক্যান্ড খাবারেই পেট ভরাতে হত। কখনও বা স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের সামান্য খাবার আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। অনেক সময় রোগীর পরিবারও আমাদের খিছু খাবার দিতেন, যাঁর কাছে যে-টুকু থাকত, সেটাই। পানীয় জলের খুব সমস্যা ছিল, কারণ শহরেরবেশির ভাগ জলের পাইপ ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমার আঘাতে ভেঙে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: আপনার একটা ‘সাধারণ’ দিনের কথা বলুন।
উত্তর: সকালে উঠে সব স্বাস্থকর্মী এক সঙ্গে প্রার্থনা করতাম। কাজ শুরু হত সকাল ৯টা। এই দেরির কারণ— আমাদের মতো সেফ হাউসে থাকা চিকিৎসক ছাড়া নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীদের শরণার্থী তাঁবু থেকে হেঁটে আসতে হত। তাঁদের কারওরই বাসস্থান ছিল না। সারা দিন হাসপাতাল চালাতেন ডাক্তারির রেসিডেন্ট শিক্ষার্থীরা, তাঁরাই ছিলেন হাসপাতালের প্রধান চালক। তাঁরাই ঠিক করতেন কোন সার্জারি কখন হবে, ইন্সট্রুমেন্টসের রক্ষণাবেক্ষণ, রোগীদের দেখাশোনা করা, তাঁদের পরিবারের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সব কাজই করতেন এই রেসিডেন্ট শিক্ষার্থীরা। তাঁরা সারাক্ষণ হাসপাতালেই থাকতেন, আর তাঁদের পরিবার থাকতেন অস্থায়ী ক্যাম্পে। সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলত সার্জারি।
প্রশ্ন: কী ধরনের রোগী পেতেন?
উত্তর: মূলত বাচ্চারাই আসত, হাড় ভাঙা, পুড়ে যাওয়ার মতো নানা ধরনের আঘাত নিয়ে। অর্থোপেডিক সার্জন আর আমি একসঙ্গে কাজ করতাম। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ছোট্ট শরীরগুলো, স্প্লিন্টার গেঁথে থাকত, অনেক সময়েই হাড় ভেঙে বাচ্চাদের পাতলা চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে আসত মাংস। কত পোড়া বাচ্চাও যে আসত! অজস্র রোগী, অথচ প্রয়োজনীয় ইন্সট্রুমেন্টস নেই।
প্রশ্ন: কি করতেন তখন?
উত্তর: পুড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আয়োডিন সলিউশন যে-টুকু পেতাম তা দিয়ে কাজ চালাতাম। যে ভাবে সম্ভব হত, সার্জারি করতাম।
প্রশ্ন: কোনও বিশেষ ঘটনার কথা বলবেন?
উত্তর: হালা-র কথা ভুলতে পারি না। তিন বছর বয়স। সর্বাঙ্গে পোড়া নিয়ে এসেছিল। বোমা নয়, শরণার্থী শিবিরে একটা ফুটন্ত জলের ডেকচিতে পড়ে যায়। ক্যাম্পে যে-হেতু সব কিছু খোলা, রান্নাও হয় খোলা জায়গায়, আর সেখানে বাচ্চাদের ঠিকমতো দেখেও রাখা যায় না, এই ধরনের দুর্ঘটনা হতেই পারে। ওর চিকিৎসা ওই হাসপাতালে করা যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করে হালা-র পাসপোর্ট করা হয়। হালা আর ওর মাকে বস্টনের একটা হাসপাতালে আনার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। ইতিমধ্যে আমাকে ওই হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আমি ওখান থেকে আসার দেড় সপ্তাহের মাথায় ওই হাসপাতালে আক্রমণ চালানো হয়, নিহত হয় হালা। শুধু বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র নয়, সংক্রমণ, চূড়ান্ত অপুষ্টি, নানা ধরনের দুর্ঘটনা, এ সবের মধ্যেই রয়েছে শিশুগুলি। তার মধ্যেও তারা হাসত, খেলে বেড়াত।
প্রশ্ন: কত কাছ থেকে বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র দেখেছেন?
উত্তর: (একটু হেসে) বোমা... ধরুন ৪০০-৫০০ মিটার। আর ক্ষেপণাস্ত্র ৯০ মিটার দূরেই পড়েছে।
প্রশ্ন: এরপর কি অন্য হাসপাতালে?
উত্তর: হ্যাঁ, আল আকসা মেটারনিটি হাসপাতাল। এটি একটি মেটারনিটি হাসপাতাল, যেখানে অস্ত্রোপচারের জন্য মাত্র কয়েকটি ঘর ছিল। বাচ্চাদের জন্ম ছাড়া এই হাসপাতালে শিশুদের অন্যান্য চিকিৎসাও চলত। মূলত একটি হেলথ কেয়ার সেন্টার হিসেবে কাজ করত হাসপাতালটি। কিন্তু চিকিৎসার সরঞ্জাম ছিল না। এমনকি যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করাও দুঃসাধ্য ছিল। এই হাসপাতালে কিছু দিন থাকার পরেই আমাকে ফিরে আসতে হয়।
প্রশ্ন: গাজ়ার হাসপাতালগুলির চিকিৎসকদের সঙ্গে এখনও আপনার যোগাযোগ রয়েছে?
উত্তর: আছে তো। যদি কখনও ওঁদের মোবাইলে সিগন্যাল পাই,কথা হয়।
প্রশ্ন: সুযোগ পেলে গাজায় ফিরবেন?
উত্তর: ফিরছি তো। কখন, কী ভাবে সেটা আপাতত উহ্য থাকুক। কিন্তু ফিরছি। পরিবারের সমর্থন নিয়েই। খুব তাড়াতাড়িই।
(এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই গাজ়ায় ফিরে গিয়েছেন সৈয়দ সাইদ।)