তালিবান হানায় পাক ছায়া দেখছে দিল্লি

সন্ত্রাস-দীর্ণ আফগানিস্তানের নিরিখেও এই দৃশ্য বেশ ‘নাটকীয়’! পার্লামেন্ট কক্ষ ভরে গিয়েছে কালো ধোঁয়ায়। আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছেন পার্লামেন্টের সদস্যরা। পার্লামেন্টের ভেতরে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছে ছ’জন তালিবান। তার কয়েক মুহূর্ত আগেই পার্লামেন্টের মূল ফটকের সামনে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছে এক আত্মঘাতী জঙ্গি।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০২:৩৪
Share:

পড়ে রয়েছে নিহত জঙ্গিদের দেহ। পার্লামেন্ট চত্বরে সংঘর্ষের পর। সোমবার কাবুলে। ছবি: এএফপি।

সন্ত্রাস-দীর্ণ আফগানিস্তানের নিরিখেও এই দৃশ্য বেশ ‘নাটকীয়’!

Advertisement

পার্লামেন্ট কক্ষ ভরে গিয়েছে কালো ধোঁয়ায়। আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছেন পার্লামেন্টের সদস্যরা। পার্লামেন্টের ভেতরে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছে ছ’জন তালিবান। তার কয়েক মুহূর্ত আগেই পার্লামেন্টের মূল ফটকের সামনে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছে এক আত্মঘাতী জঙ্গি। পোড়া জিপের পাশেই পড়ে রয়েছে তার ছিন্নভিন্ন দেহ। একটু দূরেই পড়ে এক মহিলা ও এক শিশুর দেহ। কাবুলের সাম্প্রতিকতম জঙ্গিহানার বলি।

সংবাদসংস্থার খবর, আজ সকালে আফগানিস্তানের পার্লামেন্টে এই তালিবান হামলায় মৃতের সংখ্যা ন’জন। আহত কমপক্ষে ৩১। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই মহিলা ও শিশু। দু’ঘণ্টা অভিযানের শেষে আফগান সেনার হাতে মৃত্যু হয়েছে সাত জঙ্গিরও। তবে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের মুখপাত্র নজীব দানিশ জানান, পার্লামেন্টের সব সদস্যই অক্ষত।

Advertisement

এ বছরের শেষে আফগানিস্তানের নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাবুল যাওয়ার কথা। ওই ভবনটি তৈরি করছে ভারতই। কিন্তু তার আগে, নির্মীয়মান নতুন ভবনটির কাছেই, কাবুলের বর্তমান সংসদ ভবনে আজকের তালিবান হামলার ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে সাউথ ব্লকে। কারণ এই ধরনের হামলার পিছনে ইসলামাবাদের স্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। আজকের হামলার কড়া নিন্দা করে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রের উপর এ ধরনের আঘাত কখনওই মেনে নেওয়া যায় না। আফগানিস্তানের এই দুঃসময়ে আমরা তাদের পাশে আছি।’’

শুধু আজকের বিস্ফোরণই নয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানির জমানায় আফগানিস্তানে যে লাগাতার হামলা চলছে, তার জন্য বর্তমান আফগানিস্তান সরকারের ভ্রান্ত পাক-নীতিই দায়ী বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। গত বছর ক্ষমতায় আসার পরে ঘানি পাকিস্তানের সঙ্গে যে ভাবে সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন তার ফল তাঁকে এখন হাড়ে হাড়ে টের পেতে হচ্ছে বলে মনে করছে দিল্লি।

ঘানির ধারণা ছিল, তালিবানকে আলোচনার টেবিলে বসাতে পাকিস্তান সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তালিবানি হামলা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। কাবুলের ‘হাই সিকিওরিটি জোন’-কে যে ভাবে নিশানা করা হচ্ছে, তা আগে হয়নি। ঠিক যেমন হল আজ সকালে।

আজ কী ভাবে হামলা চালাল তালিবান? পার্লামেন্টের অধিবেশন তখন সবে শুরু হয়েছে। আচমকা বিকট একটা শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগে পর পর আরও বিস্ফোরণ। টিভিতে তখন পার্লামেন্ট অধিবেশনের সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। পার্লামেন্ট কক্ষ হঠাৎ ধোঁয়ায় ভরে যাওয়ায় স্পিকার আবদুল রউফ ইব্রাহিমি প্রথমে শান্ত স্বরে বলে ওঠেন, ‘‘আপনারা সবাই একটু স্থির হয়ে বসুন। মনে হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগে কিছু বিঘ্ন ঘটেছে।’’ তাঁর ভুল ভাঙতে অবশ্য বিশেষ দেরি হয়নি। পার্লামেন্ট কক্ষে তত ক্ষণে ঢুকে পড়েছে সশস্ত্র জঙ্গিরা। পুলিশের সঙ্গে তাদের গুলির লড়াইও শুরু হয়ে গিয়েছে।

তত ক্ষণে মধ্য কাবুলের আকাশ ঢেকে গিয়েছে কালো ধোঁয়ায়। এমপি মহম্মদ রেজা কোশাক বললেন, ‘‘কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো বাড়িটাই ধোঁয়ায় ভরে যায়। সবাই তখন প্রাণ বাঁচাতে পালাতে শুরু করেছেন।’’ আজ যখন হামলা হয়, তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই পার্লামেন্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে প্রেসিডেন্ট ঘানি কার নাম নেন, তা জানতে তখন সবাই উৎসুক। হামলার কিছু ক্ষণের মধ্যেই গোটা ঘটনার দায় স্বীকার করে তালিবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘‘দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর নাম ঘোষণা হওয়ার সময়ই আমরা পার্লামেন্টে হামলা চালিয়েছি।’’

আজকের হামলা বর্তমান আফগানিস্তানে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সে দেশের উত্তরাঞ্চল কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তালিবান-আতঙ্ক এতটাই যে, সীমান্তবর্তী তাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তানের রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছে। কাবুলে জঙ্গি হামলাগুলির পিছনে রয়েছে যে হক্কানি নেটওয়ার্ক, তা পাকিস্তানেরই মদতপুষ্ট। পাকিস্তানের উপজাতি এলাকায় তালিবানের গোপন ঘাঁটির সংখ্যা খুব কম নয়। প্রেসিডেন্ট ঘানি ভেবেছিলেন, ইসলামাবাদের সাহায্যে তালিবানকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু সে কাজে পাকিস্তানের সদিচ্ছার কোনও পরিচয় এখনও পর্যন্ত পাচ্ছে না কাবুল। পাচ্ছে না নয়াদিল্লিও।

সাউথ ব্লকের এক কর্তার কথায়, ‘‘কাবুলের প্রতি ইসলামাবাদের যে ঔপনিবেশিক মানসিকতা, তা কখনই পাল্টাবে না। এর পিছনে পাকিস্তানের ভারত-বিরোধী মনোভাবও কাজ করে।’’ বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের মতে, ভারতকে চোখ রাঙিয়ে আলোচনার রাস্তায় আনা ইসলামাবাদের বহু দিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ফলে ঘানির কথা শুনে তালিবান ঘাঁটি ধ্বংস করতে নেমে পড়বে পাকিস্তান, এ রকম ভাবার কোনও কারণ নেই।

তবে প্রবল অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট ঘানি সম্প্রতি ইসলামাবাদ সম্পর্কে সুর কিছুটা চড়া করেছেন। সম্প্রতি আফগানিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে একটি কড়া চিঠি লেখা হয়েছে পাকিস্তানকে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং মৈত্রী গড়তে প্রেসিডন্ট ঘানি যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তার কোনও প্রতিদান পাওয়া যাচ্ছে কি না তা জানতে আফগানবাসী উৎসুক।’ পাশাপাশি, আইএসআই-এর সঙ্গে কাবুলের গোয়েন্দা সংস্থা যে সমঝোতাপত্র সই করেছিল, সেটি পুর্নবিবেচনা করে দেখবেন বলে জানিয়েছেন খোদ ঘানি। নয়াদিল্লির দাবি, এই সমঝোতা আসলে ভারত-বিরোধী গোয়েন্দা গোষ্ঠীরই নামান্তর। তবে আফগান প্রেসিডেন্টের এই অবস্থান কতটা ঘরোয়া রাজনৈতিক শিবিরের ক্ষোভ কমানোর জন্য আর কতটা পরিস্থিতির চাপে— তা নিয়ে নিঃসংশয় নয় সাউথ ব্লক।

সব মিলিয়ে হিন্দুকুশ পর্বতের ও পার থেকে কোনও আশার আলো এখনও দেখতে পাচ্ছে না ভারত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement