কিশলয় দে। ফাইল ছবি।
একটি তারার মৃত্যু। আর সেই মৃত্যু-মুহূর্তে একটি গ্রহকে গিলে খাচ্ছে সে!
এই প্রথম এমন এক মহাজাগতিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একটি বিজ্ঞানী দল। যার পুরোভাগে ছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী কিশলয় দে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’ পত্রিকায়। নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী আবিষ্কার, কারণ এমন দৃশ্য কেউ আগে দেখেনি। ‘প্রথম’ হওয়ার আনন্দে তাই বেশ উচ্ছ্বসিত কিশলয়। আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে, ফোনের ও-পার থেকে ভেসে আসা গলায় ঝরে পড়ল সাফল্যের আনন্দ।
কলকাতার তালতলা অঞ্চলের ছেলে। স্কুলজীবন এ শহরেই। এর পর বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি) থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা। পরবর্তী কালে ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’-তে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে আমেরিকা পাড়ি। বর্তমানে এমআইটি-তে গবেষণা করছেন। কিশলয় বললেন, ‘‘আমার পুরো পরিবারই কলকাতায় রয়েছেন। সকলে খুব খুশি।’’
এ কাহিনির শুরু ২০২০ সালের মে মাসে। কিশলয় জানান, আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নক্ষত্রদের পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। তারাদের ঔজ্জ্বল্য কখনও বাড়ে, কখনও কমে। হঠাৎ এক দিন দেখেছিলেন একটি তারা দু’সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ১০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কিশলয় বলেন, ‘‘আগে কখনও এমন জিনিস দেখিনি।’’ অপটিক্যাল টেলিস্কোপের থেকে আরও বেশি উজ্জ্বল দেখায় ইনফ্রারেড টেলিস্কোপে। দু’তিন মাস পরে স্পেকট্রাম পরীক্ষা করা হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেন, নক্ষত্রটি যে বিশালাকার ধারণ করেছে, তার বাইরের স্তরে রয়েছে ঠান্ডা গ্যাস।
নক্ষত্রের এই ধরনের চরিত্র কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে দেখা যায়। সাধারণত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নক্ষত্র ফুলেফেঁপে আকারে বড় হতে থাকে। শক্তি হারিয়ে ক্রমশ মূল আকারের থেকে প্রায় কয়েক লক্ষ গুণ বড় হয়ে যায়। এ অবস্থায় যখন কোনও বাইনারি স্টার বা পাশাপাশি থাকা নক্ষত্র একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে যায়, তখন বিস্ফোরণ ঘটে এমন অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য তৈরি হয়। এত দিন এটাই জানা ছিল। কিন্তু ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। দু’টি তারা যদি জুড়ে যেত, তা হলে আরও ১০০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল হত। এ সময়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী মর্গান ম্যাকলয়েডের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন কিশলয়। তাঁরা দেখেন, এই ১০০০ গুণ কম ঔজ্জ্বল্যের কারণ একটাই হতে পারে, দু’টি তারা নয়, একটি তারার সঙ্গে একটি গ্রহ জুড়ে গিয়েছে। ঔজ্জ্বল্যের তীব্রতা বিচার করে তাঁরা দেখেন, নক্ষত্রটি আকারে সূর্যের মতোই, অতএব গ্রহটির ভর বৃহস্পতির মতো হবে। সে ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ঔজ্জ্বল্য তৈরি হবে। কিশলয় বলেন, ‘‘যত বেশি মাধ্যাকর্ষণ, তত বেশি শক্তি, তত পরিমাণ ঔজ্জ্বল্য।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘নক্ষত্র যখন মরতে থাকে, তখন ক্রমশ আকারে বড় হতে থাকে। এতটাই বড় হয়ে যায় যে তার গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তারার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারাটিও উল্টো দিকে গ্রহকে ধাক্কা দিতে থাকে। প্রবল শক্তি তৈরি হয়। যার জন্য ওই ঔজ্জ্বল্য।’’
কিশলয়রা যে নক্ষত্রটিকে দেখেছেন, সেটি আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথেই (মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি) রয়েছে। পৃথিবী থেকে ১২ হাজার আলোকবর্ষ দূরে আকিলা নক্ষত্রপুঞ্জে। তারাটি আকারে সূর্যের সমান। সূর্যের আকারের একটি তারার আয়ু ১ হাজার কোটি বছর। কিশলয় জানিয়েছেন, আমাদের সৌরপরিবারেও এটা-ই ঘটবে। আজ থেকে আনুমানিক ৫০০ কোটি বছর পরে যখন সূর্যের শক্তি ফুরিয়ে আসবে, তার কাছাকাছি থাকা তিনটি গ্রহ— বুধ, শুক্র ও পৃথিবী সূর্যের অগ্নিগহ্বরে ঝাঁপ দেবে। তিনি বলেন, ‘‘যেন টাইম মেশিনে চেপে শেষের সে দিনটা দেখে নিলাম!’’