করোনার করাল হানা রোখা যাচ্ছে না কিছুতেই। শুধুমাত্র মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বা সর্বোপরি লকডাউনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ যে এই মারণ ভাইরাসের গতি রুখতে বেশি দিন কার্যকরী হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতে ইতিমধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যাটা ছাড়িয়েছে সাড়ে ১১ লক্ষেরও বেশি। মঙ্গলবার সকালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রকাশিত বুলেটিন অনুযায়ী, দেশে সংক্রমিতের মোট সংখ্যা ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার ১৯১। এবং বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাসের গ্রাসে প্রায় দেড় কোটি। করোনা-ধ্বস্ত বিশ্বে তাই প্রতিষেধকের খোঁজে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন গবেষকরা। টিকা তৈরির কাজে কোন দেশের অগ্রগতি কতটা? এ বিষয়ে এগিয়েই বা রয়েছে কারা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধকের খোঁজে দ্রুত গতিতে গবেষণা চলছে বিশ্ব জুড়ে। পিছিয়ে নেই ভারতও। এখনও পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে ১৫৫টিরও বেশি প্রতিষেধক তৈরির কাজ চলছে সমান্তরাল ভাবে। এর মধ্যে ২৩টি টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে মানবদেহে। প্রতিষেধক তৈরির গতিতে কে এগিয়ে? কোন দেশ রয়েছে দ্বিতীয় সারিতে? সেই চুলচেরা বিচারের আগে জেনে নেওয়া যাক, বাজারে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে একটি ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা মূলত ক’টি ধাপ পার হয়? তাতে সাধারণত কতটা সময় লাগে?
গবেষণাগারে একটি প্রতিষেধক তৈরির পর প্রথম যে ধাপের বাধা সামনে থাকে, তা হল প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা টেস্টিং। এই পর্যায়ে গবেষকরা প্রতিষেধকটি ইঁদুর বা বাঁদরের মতো প্রাণীর দেহে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করেন। মূলত দেখা হয়, ওই প্রতিষেধকটি তাদের দেহে কোনও প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে কি না! প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর শুরু হয় প্রথম পর্যায় (ধাপ-১) বা সেফটি ট্রায়াল। এই পর্যায়ে অত্যন্ত অল্প সংখ্যক ব্যক্তির উপরে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়। ওই ব্যক্তিদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি না, তা নজর রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে ওই প্রতিষেধকটি ক্ষতিকর কি না, তা বুঝতে কম পক্ষে তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়।
প্রথম পর্যায়ে সফল হলে, প্রতিষেধকটির পরবর্তী পর্যায় (ধাপ-২) বা এক্সপ্যান্ডেড ট্রায়াল চালানো হয়। এই ধাপে বাচ্চা, বয়স্ক, এ রকম বিভিন্ন বয়সের ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ করে ১০০ জন রোগীর দেহে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষেধকটি কতটা নিরাপদ এবং তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম কি না, তা দেখা হয়। এই ধাপে সাধারণত তিন মাস অপেক্ষা করা হয়। আক্রান্তেরা সুস্থ হচ্ছেন কি না, বা শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কি না, তা-ও দেখা হয় এই ধাপে।
প্রথম দুই ধাপ পার হওয়ার পর তৃতীয় পর্যায় (ধাপ-৩) বা এফিকেসি ট্রায়াল শুরু করা হয়। এ ক্ষেত্রে হাজার জনের উপর প্রয়োগ চলে প্রতিষেধকটির। এই পর্যায়েও সাধারণত থাকে তিন মাসের অপেক্ষা। কত জন সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেন, তা দেখা হয় এই ধাপে। প্রথম তিন পর্যায়ে পরীক্ষণের পর আসে চতুর্থ পর্যায় (ধাপ-৪)। এই ধাপের ফলাফল দেখে টিকা তৈরির ছাড়পত্র দেয় প্রতিটি দেশের নিয়ামক সংস্থা। প্রতিটি ধাপের ফলাফল খতিয়ে দেখে তা পর্যালোচনা করে সন্তুষ্ট হলে তবেই পাওয়া যায় ছাড়পত্র। তবে অতিমারির আবহে আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই অনেক সময় প্রতিষেধকের প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া, প্রতিষেধক দ্রুত তৈরিতে চারটি ধাপ সংযুক্ত ভাবে চালানো যেতে পারে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণের কাজ শুরু হয়। এর পর মানবদেহে কোভিড প্রতিষেধকের প্রথম ট্রায়াল হয় গত মার্চে। এর পর থেকে বার বার পরীক্ষা নিরীক্ষা চলেছে। তবে সাফল্য এখনও অধরা।
করোনাভাইরাস সবচেয়ে প্রথমে ছড়িয়েছিল চিনের উহান প্রদেশ থেকে। করোনার টিকার খোঁজে সেই চিন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। চিনের ক্যানসাইনো বায়োলজিক্যাল ইনকর্পোরেশন এবং বেজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োটেক-এর তৈরি কোভিড প্রতিষেধক শেষ অর্থাৎ তৃতীয় পর্যায় (ধাপ-৩)-এ পরীক্ষাধীন রয়েছে। ক্যানসাইনো-র টিকা এই মুহূর্তে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
চিনের অন্যান্য গবেষণা সংস্থাগুলিও জোরকদমে টিকা তৈরির কাজ করছে। সে দেশের উহান ইনস্টিটিউট, সিনোফার্মের টিকা রয়েছে দ্বিতীয় ধাপে। অন্য দিকে, তৃতীয় ধাপে রয়েছে সিনোভ্যাক বায়োটেক এবং ইনস্টিটিউটো বুট্যানটান, রয়েছে বেজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস, সিনোফার্মের মতো সংস্থার টিকা।
করোনা ভ্যাকসিনের কাজে চিন ছাড়াও সফল হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে ব্রিটেনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। চিনের মতোই ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বায়োফার্মা কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা-কে সঙ্গে নিয়ে করোনা-প্রতিষেধক তৈরি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জুন মাসে জানিয়েছিল, করোনার প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি আশার আলো দেখাচ্ছে ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র এজেডডি১২২২ (গোড়ায় যার নাম ছিল ‘চ্যাডক্স-১’) ভ্যাকসিন। এটি এখন তৃতীয় ধাপে রয়েছে। এ ছাড়া, লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের টিকা রয়েছে দ্বিতীয় ধাপে।
চিন বা ইংল্যান্ডের পাশাপাশি আমেরিকার সংস্থাগুলিও টিকা তৈরির কাজে আশার আলো দেখাচ্ছে। আমেরিকার নোভাভ্যাক্স, মডার্না ভ্যাকসিন তৈরিতে উল্লেখযোগ্য নাম। নোভাভ্যাক্সের টিকা এখন রয়েছে দ্বিতীয় ধাপে। অন্য দিকে, মডার্নার তৈরি টিকা তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।
এশিয়া বা আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপেও চলছে করোনা টিকার সন্ধান। জার্মানির বায়োএনটেক, ফোজান ফার্মা এবং ফাইজারের টিকা এখন রয়েছে দ্বিতীয় ধাপে। অন্য দিকে, অস্ট্রেলিয়ার ভ্যাক্সিন পিটিওয়াই লিমিটেডের তৈরি প্রতিষেধক রয়েছে প্রথম ধাপে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে গোটা বিশ্বে রাশিয়া রয়েছে প্রথম পাঁচের মধ্যে। রাশিয়াতেও চলছে এই টিকার সন্ধান। সেখানকার সেচনেভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, তাঁদের তৈরি টিকা এই মুহূর্তে দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই এ দেশেও দ্রুত গতিতে চলছে কোভিড ভ্যাকসিনের খোঁজ। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, করোনা প্রতিষেধকের দৌড়ে সব দেশকে ছাপিয়ে যেতে পারে ভারত। ইতিমধ্যেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের ঘোষণা, আগামী ১৫ অগস্টের মধ্যে দেশীয় বাজারে আসবে কোভ্যাক্সিন। দেশে তৈরি করোনা প্রতিষেধক। যদিও এত দ্রুত তা সম্ভব কি না, সে নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) জানিয়েছে, হায়দরাবাদের ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (বিবিআইএল)-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ওই প্রতিষেধক বাজারে আনছে তারা। এ দেশে প্রতিষেধক তৈরির কাজে ভারত বায়োটেক-এর পাশাপাশি দৌড়ে রয়েছে জাইডাস ক্যাডিলার মতো সংস্থা। তবে দেশীয় প্রতিষেধকটি এখন প্রথম ধাপেই রয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে করোনা ভ্যাকসিনের দৌড়ে কোন দেশ কী পর্যায়ে রয়েছে? এক ঝলকে তা দেখে নিন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে তৈরি করা হলেও সব প্রতিষেধক যে একই ধরনের হয়, তা নয়। প্রতিষেধকেরও বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যে সমস্ত প্রতিষেধক জেনেটিক, তা এক বা একাধিক করোনাভাইরাসের নিজস্ব জিন ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এই ধরনের প্রতিষেধকের কাজ মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরীক্ষা করা।
ভাইরাল ভেক্টর প্রতিষেধক: এই ধরনের প্রতিষেধক একটি ভাইরাসের মাধ্যমে কোষের ভিতরে করোনাভাইরাসের জিন ঢুকিয়ে দেয়, এবং তা দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরীক্ষা করে। রয়েছে প্রোটিন বেসড ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক। একটি করোনাভাইরাসের প্রোটিন বা প্রোটিনের অংশ ব্যবহার করে এই প্রতিষেধক মানবদেহে প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরীক্ষা করে। এ ছাড়াও আরও এক ধরনের ভ্যাকসিন হল হোল-ভাইরাস ভ্যাকসিন। এই প্রতিষেধক করোনার সবচেয়ে দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় সংস্করণকে ব্যবহার করে প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেয়। অন্। দিকে দেখা যায়, রিপারপাসড ভ্যাকসিনও। এই ধরনের ভ্যাকসিন হল অন্যান্য রোগের জন্য ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত প্রতিষেধক, যার মাধ্যমে কোভিডের হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
প্রতিষেধকের বিভিন্ন ধাপ বা ধরন সম্পর্কে জানা গেলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কোন দেশের প্রতিষেধক দ্রুত বাজারে আসার ক্ষেত্রে সামনের সারিতে রয়েছে? এই মুহূর্তে প্রতিষেধক তৈরিতে সামনের সারিতে রয়েছে চিন এবং ব্রিটেন। তবে যে কোনও মুহূর্তে এই প্রতিযোগিতার রং বদলে যেতে পারে। পুরো বিষয়টিই নির্ভর করছে মানবদেহে পরীক্ষার পর সেই প্রতিষেধকের ফলাফলের উপর!