আইফেল টাওয়ারের সামনে সেলফি।—ছবি রয়টার্স।
মেঘান্ধকার আকাশের আবেশ ছিঁড়ে আলো ভাসিয়ে দিচ্ছে যানবাহনহীন ও জনমানবশূন্য নিঃশব্দ রাস্তা, বসন্তের বাগান, বাড়ির উঠোন। দূরে ইতস্ততঃ পাখিদের ডাক। জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে ভাবছি, এই পথ-চাওয়ার কি শেষ নেই?
প্যারিসে গত ৬ই মার্চ থেকে প্রেসিডেন্টের নির্দেশানুসারে, আমি একেবারে গৃহবন্দি। প্রথমে কিন্তু ছিল না এতটা আতঙ্ক। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপ যে মানব সভ্যতার দর্পকে এ ভাবে পায়ের তলায় চূর্ণ করে দেবে, তা বোধ হয় ভাবতে পারেননি কেউই। ফরাসিরা তো নয়ই। মনে পড়ছে জানুয়ারির গোড়ার দিকে এই ভাইরাসকে নিয়ে বেশ ঠাট্টা-তামাশাই করেছিলেন আমার সহকর্মীরা। এক জন বলেছিলেন, এ চিনের স্থানীয় মহামারি, আমাদের এ বিষয়ে বিশেষ চিন্তার প্রয়োজন নেই। মধ্য-ফেব্রুয়ারিতে পড়শি ইটালির ভীতিকর অবস্থার মাঝে ফ্রান্সে ধরা পড়ল অগণিত আক্রান্তের খবর। মৃতের হারবৃদ্ধি ভাবিয়ে তুলল আমাদের, বিশেষ করে যাঁদের পরিবার থাকে ফ্রান্সের করোনা-আক্রান্তদের প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু— পূর্ব ফ্রান্সে। যেমন আমার বন্ধু ম্যাথুর বাবা-মা দু’জনেই ওখানকার এক শহরের চিকিৎসক। দৈনিক রোগীদের সংখ্যা এমন ভাবে বাড়তে লাগল, যে ওঁরা দু’জনেই অত্যধিক পরিশ্রমে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ওঁদের কাছে পর্যাপ্ত মাস্ক ছিল, তা-ও ফুরিয়ে গেল। কিন্তু সবাই যে সতর্ক হলেন, তা কিন্তু একেবারেই নয়। আমি ফেব্রুয়ারি থেকেই লক্ষ্য করছিলাম যে ফরাসি শিষ্টাচারের অংশ, পারস্পরিক চুম্বন (বিসু) কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ভাবে নিয়মিত ঘটে যাচ্ছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে, কাফেতে, রাস্তাঘাটে। বিরক্ত হয়ে বন্ধু লরোঁ মন্তব্য করেছিল, আরে বাঁচলে তবে তো চুম্বন! বন্ধ হল বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, অফিস, ল্যাব, দোকানপাট, নানান প্রদশর্নশালা, ল্যুভর। ট্রেন-মেট্রোর যাতায়াত কমে এল। বান্ধবী এলোইসের সিনেমা দেখানোর কথা ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে, কিন্তু তা-ও পিছিয়ে গেল। আমার গবেষণা পত্রের ‘ডিফেন্স’ গেল পিছিয়ে। কাজ করতে লাগলাম বাড়ি থেকে আমার অধ্যাপকদের নির্দেশে। কিন্তু তাতে কী! রবিবার ১৪ মার্চ আমি জানলা দিয়ে দেখলাম, রোদ্দুর ওঠার আনন্দে নাকি অনেক দিন আর বেরোতে পারব না এই ভেবে ফরাসি দম্পতিরা বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন, মুখে চিন্তার লেশমাত্র নেই। পাড়ার বাস্কেটবল কোর্টে দিব্যি চলছে খেলা!
পরের দিনই প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ ফরমান জারি করলেন, খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো বন্ধ। সরকারি নির্দেশপত্রে ‘জরুরি প্রয়োজন’ কী কী, উল্লেখ করা হল— ওষুধ, মাসকাবারি জিনিস ও খাবার কেনা, স্বাস্থ্যের জন্য বা অন্য অসুস্থ ব্যক্তিকে সাহায্য করা ছাড়া কোনও ভাবেই এই বাইরে যাওয়া অনুমোদনযোগ্য নয় এবং এই ফর্মে প্রত্যেক বার নিজেকে সই করে তবে বেরোতে হবে। আইন ভাঙলে ৩৫-১৩৫ ইউরো জরিমানা। এই ফরমানে কাজ হল। রাস্তায় লোক কমল। তার আগে অবশ্য কিনে নিয়েছিলাম মাসখানেকের জিনিস। সুপারমার্কেটে তখন মারকাটারি ভিড়। এক ভদ্রমহিলা দেখেছিলাম, ১২ ক্রেট ডিম, ৩৫ কার্টন দুধ ও ১২টা টয়লেট পেপার রোল নিলেন! তার পরেই নিয়ম করা হল, মাথাপিছু তিনটে করে এক জিনিস বরাদ্দ।
রাত ৮টায় আমরা মিলিতভাবে সমস্ত বাড়ির জানলায়, বারান্দায় বেরিয়ে এসে, হাততালি দিচ্ছি ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশে, তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য। গান গেয়ে উঠছেন অনেকেই। আমার প্রতিবেশী, জেরেমি চেলোতে শোপ্যাঁর সোনাটা শোনালো। আমার গলায় তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান— ‘‘নিবিড় ঘন আঁধারে, জ্বলিছে ধ্রুবতারা...।’’
(লেখক সিএনআরএসের গবেষক)