ছবি এএফপি।
ফাইজ়ার, মডার্নার পরে এ বার ফল বেরোল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা জুটির। আজ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অন্তর্বর্তিকালীন রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা জানিয়েছে, ব্রিটেন ও ব্রাজিলের ট্রায়ালে করোনা রুখতে গড়ে ৭০ শতাংশ কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে তাদের ভ্যাকসিন। দুই মার্কিন সংস্থা মডার্না ও ফাইজ়ারের নব্বইয়ের ঘরে নম্বরের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে তারা। তবু ভারত-সহ বহু দেশ তাদের দিকেই তাকিয়ে। কারণ— প্রথমত, ফাইনাল পরীক্ষায় অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা আরও ভাল ফল করলে, সস্তায় সহজলভ্য হবে প্রতিষেধক। দ্বিতীয়ত, ‘ব্র্যান্ড অক্সফোর্ড’, তাই নিরাপত্তা নিয়ে ভরসা আছে।
‘সস্তা’, ‘সহজে পরিবহণযোগ্য’ ও ‘সহজলভ্য’— এই তিনটি সাফল্যে আলাদা করে জোর দিয়ে অক্সফোর্ডকে আজ স্বাগত জানিয়েছেন ভারতে তাদের টিকা-প্রস্তুতকারী সংস্থা সিরাম ইনস্টিটিউটের কর্ণধার আদার পুণাওয়ালা। চূড়ান্ত রিপোর্টে সাফল্য নিয়ে তিনি এক রকম নিশ্চিত। সন্ধ্যায় একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রীতিমতো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পুণাওয়ালা জানিয়ে দিলেন— ‘‘মাস দুই-তিনেক লাগবে টিকা ভারতের বাজারে আসতে। ভারত সরকার আমাদের জুলাইয়ের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডোজ় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ১০ কোটি ডোজ় সরবরাহ করতে পারব আমরা।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা দাম ধার্য করেছি সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা। সরকারকে ২৫০ টাকা বা তার কম দামে সরবরাহ করা হবে। বেসরকারি জায়গাগুলিতে ৫০০-৬০০ টাকা মতো দাম পড়বে (আরও ২০০টাকা ডিস্ট্রিবিউটরের জন্য)।’’ তবে ৯০ শতাংশ ডোজ়ই সরকারকে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন পুণাওয়ালা। এখন অপেক্ষা শুধু সরকারি ছাড়পত্রের।
‘চ্যাডক্স১ এনকোভ-২০১৯’ বা সাঙ্কেতিক নাম ‘এজ়েডডি১২২২’। এই দুই নামেই পরিচিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি গড়ে একশোয় ৭০ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। সেই জায়গা থেকে চ্যাডক্স১-এর জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী পুণাওয়ালা। বিষয়টা এই রকম— দু’ধরনের পদ্ধতিতে কম্বাইন্ড বা মিশ্র ট্রায়াল হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবকদের একটি অংশকে একটি সম্পূর্ণ ডোজ়ের প্রতিষেধক দেওয়ার এক মাস পরে অর্ধেক ডোজ় দেওয়া হয়েছিল। তাতে ৯০ শতাংশ কাজ দিয়েছে টিকাটি। অন্য একটি অংশকে এক মাসের ব্যবধান দু’টি সম্পূর্ণ ডোজ় টিকা দেওয়া হয়েছিল। তাতে ৬২ শতাংশ কার্যকারিতা দেখা গিয়েছে। দু’টি ট্রায়াল মিলিয়ে গড়ে ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা। অক্সফোর্ডের বক্তব্য, প্রথম পদ্ধতিটি অনুসরণ করলে, বড় সাফল্য মিলতে পারে। মোট ২০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক অংশ নিয়েছিলেন এই কম্বাইনড ট্রায়ালে। অর্ধেক ব্রিটেন ও অর্ধেক ব্রাজিলে। যাঁদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ৩০ জনের কোভিড-১৯ হয়েছিল। ডামি ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ১০১ জনের করোনা হয়। ট্রায়ালে এক দল যে ৯০ পেয়েছে, সে বিষয়ে জোর দিয়ে পুণাওয়ালা টুইট করেন, ‘‘খবরটা পেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত। সস্তা, সহজে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়, সহজলভ্য, এমন একটি ভ্যাকসিন ট্রায়ালের একাংশে ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে।’’
আদারের বার্তা
• ভারতের বাজারে টিকা আসতে মাস দুই-তিনেক লাগবে।
• জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ১০ কোটি ডোজ় সরবরাহের লক্ষ্য।
• সর্বোচ্চ দাম ১০০০ টাকা (এমআরপি)।
• সরকারকে ২৫০ টাকা বা তার কম দামে সরবরাহ করা হবে। ৯০ শতাংশ ডোজ়ই সরকারকে বিক্রি করা হবে
• বেসরকারি ক্ষেত্রে ৫০০-৬০০ টাকা মতো দাম পড়বে (আরও ২০০ টাকা ডিস্ট্রিবিউটরের জন্য)।
বাকি নিরাপত্তা পরীক্ষায় ‘ফুল মার্কস’ পেয়েছে চ্যাডক্স১। ভ্যাকসিনটি কতটা নিরাপদ, তা খতিয়ে দেখতে একটি নিরপেক্ষ নজরদারি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। তারা জানিয়েছে, দু’ধরনের ট্রায়ালেই কোনও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধরা পড়েনি। অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা জানিয়েছে, তারা এই প্রাথমিক রিপোর্টটি অবিলম্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। জরুরি ভিত্তিতে এটি প্রয়োগ করা যেতে পারে জানিয়েও আবেদন জানানো হবে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র ছাড়পত্রও চাওয়া হবে, যাতে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো টিকা নেওয়ার সুবিধা পায়।
আরও পড়ুন: ভঙ্গুর ইগোর এক রাজনীতিক, অতিমারি-শাসক কম্পাসের কাঁটা এবং আমেরিকানদের জীবন
কিছু দিন আগে একটি রিপোর্টে অক্সফোর্ড জানিয়েছিল, প্রবীণদের শরীরে দারুণ ভাবে কাজ দিচ্ছে তাদের ভ্যাকসিন। মাঝবয়সিদের শরীরে যতটা কার্যকরী, সত্তরোর্ধ্বদের চিকিৎসাতেও সমান ফলপ্রসূ। আজকের রিপোর্ট প্রসঙ্গে ‘অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ’-এর ডিরেক্টর তথা ট্রায়ালের প্রধান তদন্তকারী কর্তা অ্যান্ড্রু পোলার্ড বলেন, ‘‘আমরা একটি পরীক্ষার একটি অংশে ভ্যাকসিনের ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা প্রমাণ করেছি। পরীক্ষাপদ্ধতির এই অংশটি অনুসরণ করে আমরা কিন্তু অনেককে টিকা দিতে পারব। অনেক মানুষকে বাঁচাতে পারব।’’ অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক সারা গিলবার্ট বলেন, ‘‘এ বার হয়তো অতিমারি শেষ হবে।’’ উচ্ছ্বসিত অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার সিইও পাস্কাল সোরিয়টও। তাঁর কথায়, ‘‘অতিমারির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন ছুঁল।’’
আরও পড়ুন: মহাত্মা গান্ধীর প্রপৌত্র করোনায় প্রয়াত দক্ষিণ আফ্রিকায়
নিজেদের তৈরি টিকা সম্পর্কে কয়েকটি বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখ করতে ভোলেননি পাস্কাল। যেমন তাঁদের লক্ষ্য, সহজ সাপ্লাই-চেন, অলাভজনক উৎপাদন, সময়ের মধ্যে নিরপেক্ষ ভাবে সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা। তিনি জানিয়েছেন, এর ফলে ছাড়পত্র পেলেই তাঁদের টিকা কম দামে (মডার্না ও ফাইজ়ারের টিকার থেকে অনেক কম দাম) পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যাবে। এর একটি অন্যতম কারণ, ব্রিটেনের পাশাপাশি ভারত থেকে ব্রাজিল, বহু দেশে তৈরি করা হবে প্রতিষেধকটি। সেই পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে জোরকদমে। ২০২১ সালে অন্তত ৩০০ কোটি ডোজ় পর্যন্ত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রাখছেন তাঁরা। পাস্কালের দাবি, সরবরাহ ব্যবস্থাও সুবিধাজনক। ভ্যাকসিনটি সাধারণ রেফ্রিজারেটরেই অন্তত ছ’মাস মজুত রাখা যাবে, এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যাবে, ব্যবহার করা যাবে।
জুটিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তাঁর কথায়, ‘‘দারুণ খবর। তবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত আরও কিছু বিষয় খতিয়ে দেখার আছে। অসাধারণ রেজাল্ট।’’ বিদেশমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক জানিয়েছেন, সব ঠিক থাকলে সামনের মাস থেকে সে দেশে টিকাকরণ শুরু করা যেতে পারে। এখনও ভারত, আমেরিকা, কেনিয়া ও জাপানে ট্রায়াল চলছে। ৬০ হাজারের কাছাকাছি স্বেচ্ছাসেবক তাতে অংশ নিয়েছেন। অক্সফোর্ডের আশা, এ বছরের শেষের মধ্যে সেই পরীক্ষার রেজ়াল্টও বেরিয়ে যাবে এবং ভাল ফল করবে তারা।