Coronavirus Lockdown

লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত বুমেরাং হবে না তো! আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের

চিকিৎসক ইয়ান লিপকিন স্পষ্ট বলছেন, ‘‘আমরা এমন ঝুঁকি নিচ্ছি যাতে ফের একটা ধস নামতে পারে। আর সেটা হয়ে উঠতে পারে অসহনীয়।’’

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

ওয়াশিংটন শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২০ ২২:২৭
Share:

রিও ডি জেনিইরো-তে ক্রাইস্ট দ্য রিদিমারের মূর্তিতে প্রতিফলিত স্বাস্থ্যকর্মীর ছবি।

করোনার ধাক্কায় টলমল করছে গোটা দুনিয়া। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। লাগামহীন ভাবে বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যাও। এই পরিস্থিতিতেই ঝুঁকি নিয়ে লকডাউন শিথিল করার পথে হাঁটছে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য ও ইউরোপের একাধিক দেশ। কিছু কিছু এলাকায় লকডাউন বিধি শিথিল করেছে ভারতও। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হবে না তো? এখন এই প্রশ্নই তুলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, লকডাউন শিথিল হলে তার ফাঁকফোকর গলে ফের হানা দিতে পারে করোনা। সেই ধাক্কা আরও ‘অসহ্য’ হয়ে উঠতে পারে। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ফের বিধি নিষেধ জারি করতে হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে স্প্যানিশ ফ্লু-এর ভয়াবহতার উদাহরণও টেনে এনেছেন অনেকে।

Advertisement

গত বছর নভেম্বরের শেষ দিকে চিনের উহানে হানা দিয়েছিল করোনা। তার পর যত দিন গড়িয়েছে ততই ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে কোভিড-১৯। আর করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে প্রায় গোটা পৃথিবী এখন লকডাউনের ঢালের আড়ালেই আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু করোনার বিরুদ্ধে আর কত দিন এই অস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে? কারণ লকডাউনের জেরে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন প্রায় স্তব্ধ। আকাশছোঁয়া হচ্ছে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ। বাড়ছে বেকারত্ব। এই পরিস্থিতিতে লকডাউনের বিধি শিথিল করে অর্থনৈতিক কাজকর্ম চালু করার পক্ষপাতী বহু দেশই। অনেকে ইতিমধ্যে সে পথে পা-ও বাড়িয়েছে। আর ঠিক এই সন্ধিক্ষণ নিয়েই সতর্কবার্তা দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনফেকশন অ্যান্ড ইমিউনিটি বিভাগের চিকিৎসক ইয়ান লিপকিন স্পষ্ট বলছেন, ‘‘আমরা এমন ঝুঁকি নিচ্ছি যাতে ফের একটা ধস নামতে পারে। আর সেটা হয়ে উঠতে পারে অসহনীয়।’’

নাগরিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার পক্ষে বহু দিন ধরেই সওয়াল করে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নরের উপরে। ইতিমধ্যেই আমেরিকার প্রায় অর্ধেক রাজ্যে লকডাউন শিথিলও করে দেওয়া হয়েছে। একই ছবি ইউরোপের কিছু দেশেও। ইটালিতে সংক্রমণের গ্রাফ এখন নিম্নমুখী। তাই শিথিল হয়েছে লকডাউন। বিধি নিষেধে কাটছাঁট করা হয়েছে জার্মানিতেও। আর এই সময়টাকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ধরছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যেমন, এই সময়ে আমেরিকার লোয়া ও মিসৌরিতে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেখানে সংক্রমণে এখনও রাশ টানা যায়নি। বরং তা বাড়ছে। ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে না তো? ঠিক এই প্রশ্নই তুলে ধরেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের অনেকেরই আশঙ্কা, এই শিথিলতার সুযোগ নিয়ে ফের হানা দেবে করোনা। ফ্রান্সের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের ভাইরাস বিভাগের প্রধান অলিভার সোয়ার্জ তো বলেই দিয়েছেন, ‘‘করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা আসবে। কিন্তু তার অভিঘাত কী পরিমাণ হবে? এটা ছোট ধাক্কা হবে না বড় ধাক্কা? সেটাই প্রশ্ন।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: বিশ্বে করোনা আক্রান্ত সাড়ে ৩৭ লক্ষ, মৃত ২ লক্ষ ৬৭ হাজার

সামনে করোনার চোখরাঙানি। পিছোলে অর্থনীতি খাদে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই শাঁখের করাতের মধ্যেই সংক্রমণ না থাকা এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার পক্ষে একাধিক দেশ। ভারতেও ইতিমধ্যে সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গ্রিন জোনগুলিতে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে একাধিক ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন ওয়াশিংটনের কাইজার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য নীতির সহকারি অধিকর্তা জশ মিকাড, তাঁর মতে, ‘‘জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নিরাপত্তা না নিয়ে আমরা যদি বিধিনিষেধ শিথিল করি, তা হলে আমাদের আরও সংক্রমণ ও আরও মৃত্যু দেখতে হবে।’’

কোন কোন জায়গায় বেশি ঝুঁকি তা নিয়েও সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। লিপকিনের মতে, পানশালা এবং বিভিন্ন খেলার সময় ভিড় বেশি হয়। সেই জায়গাগুলিই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে বলে তাঁর মত। তবে আশার ব্যাপার, লকডাউন শিথিল করা হলেও নিরাপত্তার দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। যেমন ইটালিতে নতুন নতুন সংক্রমিত ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। করোনা দ্বিতীয় বার আক্রমণ শুরু করলে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেছে জার্মানিও। তবে এখনও পর্যন্ত লকডাউন বিধি শিথিল করেনি ফ্রান্স।

কিন্তু ক্রমশ করোনার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে আমেরিকা। সেখানে মৃতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা বর্তমানে ইউরোপের অর্ধেক। সংক্রমিত হয়েছেন ১২ লক্ষের বেশি মানুষ। গবেষকরা বলছেন, এখন আমেরিকায় দৈনিক ২০ হাজার মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। দিনে মৃত্যু এক হাজার মানুষের। এমন তড়িৎ গতিতে সংক্রমণের দিকে নজর রেখেই ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, অগস্টের শুরুতেই আমেরিকায় করোনায় মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩৪ হাজারে পৌঁছে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউনের শৃঙ্খলা ভাঙার সিদ্ধান্ত কি আত্নঘাতী নয়? করোনার হানায় ঝলমলে নিউইয়র্ক কার্যত মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছিল। এখন অবশ্য সেখানে সংক্রমণে রাশ টানা গিয়েছে। সেই শৃঙ্খলার কথাই উঠে এল নিউইয়র্ক শহরের মেয়র বিল ডি ব্ল্যাসিওর কথায়। বিল বলছেন, ‘‘গোটা দেশকে আমি বার্তা দিতে চাই, সংক্রমণ শেষ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে গেলে কতটা চেষ্টা, কতটা শৃঙ্খলা প্রয়োজন তা শিখুন।’’ তিনি সাবধান করে দিচ্ছেন, শৃঙ্খলা না মানলে পরিস্থিতি বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে করোনায় মৃত প্রায় ২০০, আক্রান্ত ১২ হাজারের বেশি

অন্য দিকে লকডাউনের জেরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সঙ্গিন হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও। তাদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে করোনা ভয়াবহ আর্থিক মন্দা তৈরি করতে পারে। ইতিমধ্যেই একাধিক দেশে তার আঁচও লাগতে শুরু করেছে। কারণ এপ্রিলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ১৬ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, যা ১৯৩০-এর আর্থিক মন্দার কাছাকাছি। লকডাউন তোলা নিয়ে চাপ বাড়ছে আমেরিকার অন্দরেও। বিক্ষোভ চলছে বিভিন্ন জায়গায়। লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের হয়েছে। তার উপর সামনেই ভোট। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এর উল্টোমেরুতেই অবস্থান করছেন। এ নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেইটলিন রিভার্স। তিনি বলছেন, ‘‘আমরা এই লড়াইয়ের একটি সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে রয়েছি। এখন আত্মতুষ্টিতে ভুগলে দৈনিক মৃত্যু দু’হাজারে পৌঁছতে পারে। চেষ্টা করলে তা কিন্তু রোধ করা যায়।’’

এক বার ঢেউ তুলে মিলিয়ে যাওয়া নয়, ফের ধেয়ে আসতে পারে করোনা। রোগের এমন দ্বিতীয় বার আক্রমণের নজিরও রয়েছে ইতিহাসে। যেমন ঘটেছিল একশো বছর আগে, স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময়। প্রথম বার যে শক্তি নিয়ে এসেছিল ওই মারণ ভাইরাস, দ্বিতীয় বার তার ধাক্কা ছিল বেশ কয়েক গুণ জোরালো। তার অন্যতম কারণ, ফিলাডেলফিয়া থেকে সানফ্রান্সিসকো, জন সমাগমে কোথাওই বাধা দেওয়া হয়নি। করোনার ক্ষেত্রেও সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement