অতীত: স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে আফগান স্কুল ছাত্রীরা। ২০০২-এর ১৯ অগস্ট। নিজস্ব চিত্র।
সে যেন ২১ ফেব্রুয়ারির আগের রাতের ঢাকা শহর।
২০০২ সাল। ১৮ অগস্ট। উন্মাদনায় মেতে উঠেছে কাবুল। রাস্তায় টাঙানো হচ্ছে লাল-নীল আলোর মালা, আহমেদ শাহ মাসুদের ছবি, ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে কামানের গোলায় ভেঙে যাওয়া ট্র্যাফিক আইল্যান্ড।
দুপুরেই স্থানীয় আফগান সহকর্মীদের কাছ থেকে একাধিক নিমন্ত্রণ পেয়েছি। কোকোদি, আমাদের রান্নার মাসি, বাড়ির ফল দিয়ে গিয়েছেন আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে। পর দিন, ১৯ অগস্ট কোকোদি আসবেন না। স্বাধীনতা দিবস যে! স্টেডিয়ামে প্যারেড দেখতে যাবেন পরিবারের সবাই মিলে।
উত্তেজনাটা মালুম হল স্টেডিয়ামে গিয়ে। কানায় কানায় পূর্ণ কাবুল স্পোর্টস স্টেডিয়াম। যেখানে এক সময় সামান্য কারণে সবার সামনে পাথর ছুড়ে, গুলি করে মারা হতো গরিব আফগানদের। সেখানেই আজ মানুষের ঢল খুশিতে ভাসছে। নজরে পড়ছিল মহিলাদের উপস্থিতি। যেন আফগান মহিলাদের স্বাধীনতা দিবস। শত শত ছাত্রী, বিভিন্ন বয়সের মহিলা মুখের আবরণ সরিয়ে বীরদর্পে প্যারেডে অংশ নিচ্ছেন। কারও হাতে স্বাধীনতার পোস্টার, কারও হাতে ফুলের তোড়া। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ঘোষণা করলেন, আফগানিস্তানের প্রথম মহিলা প্যারাট্রুপার নামছেন স্টেডিয়ামে। হাততালিতে ফেটে পড়ল স্টেডিয়াম, ছবি তোলার ফাঁকে নিজেও হাততালি দিয়ে নিলাম প্রাণভরে।
আফগান সেনাবাহিনীর পাশে পাশে লাঠিখেলা আর বন্দুক নিয়ে নাচ স্থানীয় বয়স্ক মানুষদের। এই বন্দুক-নৃত্য আফগান ঐতিহ্য। দীর্ঘ তালিবানি শাসন তখন সবে মাত্র শেষ হয়েছে। মুক্তির উচ্ছ্বাসে ফুটছে আফগানিস্থান। আর সেই মুক্তির সব চাইতে বড় ভাগিদার দেশের বিপুল মহিলা সমাজ, যে সমাজের কোনও মুখ ছিল না এত দিন। ছিল শুধু বোরখা। এরই মধ্যে কাবুল শহরে খুলে গেছে প্রায় সমস্ত স্কুল, সেখানে ছাত্রীদের সংখ্যা নজরে পড়ার মতো। শহরের ইন্টারনেট বুথে আফগান মহিলাদের আনাগোনা। এমনকি, মহিলাদের শারীরচর্চার জন্য শহরে খুলেছে জিম। রাস্তাঘাটে হামেশাই একা মহিলাদের দেখা যাচ্ছে। এই সব আমার নজরে খুব স্বাভাবিক মনে হত। কিন্তু আমার গাড়ির আফগান চালক সেলিমদা প্রতি পদে মনে করিয়ে দিতেন, তালিবান জমানায় মহিলাদের বাড়ির বাইরে বেরনোর কোনও সুযোগই ছিল না। অসুস্থ হলে সঙ্গে পুরুষ মানুষ না থাকলে, ডাক্তার বা ওষুধের আগে পুরুষ মানুষ খুঁজতে হত মহিলা রোগীকে।
আজ ঠিক ১৯ বছর পরে, যখন সকালে কাগজে দেখলাম তালিবরা কাবুল শহর থেকে আর মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে, কাবুলের পতন আর কিছু ঘণ্টার অপেক্ষা, তখন ওই দেশের মহিলাদের কথা ভেবে শিউরে উঠছি। একটা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বন্দুকের কাছে, ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে হার স্বীকার করতে হচ্ছে।
তখন দেখেছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত, অভাব-অভিযোগে জীর্ণ একটা দেশ মুক্তির আনন্দে ভাসছে। শহরে একটা বাড়ি নেই, যেখানে বুলেটের ক্ষত নেই, কামানের গোলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সিনেমা হল, আফগান টাকার প্রায় কোন দামই নেই। রাস্তায় পড়ে থাকে টাকা, ভিখারিও তোলে না। মানুষ বাজারে যায় কাঁধে করে টাকা নিয়ে। শহরের রাস্তায় হাজারে হাজারে শিশু শ্রমিক। অনেকেরই বাবা যুদ্ধে মারা গিয়েছেন বা মাইন বিস্ফোরণে পঙ্গু। প্রতি দিন আশপাশের দেশ থেকে আছড়ে পড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল। রাষ্ট্রপুঞ্জ পরিচালিত উদ্বাস্তু কেন্দ্রে রেশনের লাইনে দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সবার হাতের চামড়ায় লেখা উদ্বাস্তু নম্বর। তবুও মুখে হাসি লেগে আছে।
ভারত থেকে এসেছি জানলেই বুকে জড়িয়ে ধরেন সাধারণ আফগানরা। ভারত বন্ধু দেশ। ভারতীয় হওয়ার কারণে এই বিশেষ খাতির বেশ লাগত। বিকেলের পর চিকেন স্ট্রিটের আড্ডায় ভারত-প্রেমের অনেক গল্প মনে পড়েছে। সেই আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সৈয়দ মুজতবা আলি, দিলীপ কুমার, সায়রা বানু থেকে কুমার শানু কেউই বাদ যাননি। আর এখন রোজই খবরের কাগজে পড়ছি, আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহর থেকে ভারতীয়দের দ্রুত দেশে ফেরার আর্তি। কিছুতেই মেলাতে পারছি না আমার দেখা সেই দেশটার সঙ্গে।