বর্তমান: বিনামূল্যে গম সংগ্রহ করার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন আফগান মহিলারা। কাবুলে। ছবি—রয়টার্স।
দিনে-রাতে এখন প্রায়ই ধাক্কা পড়ে দরজায়। গৃহস্থ বুঝে যায়, ‘ওরা’ এসেছে। খাবার চাইবে। জবরদস্তি ঢুকে পড়ে বলতে পারে, এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে। কিচ্ছু করার নেই। ওদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ, না-তে না মেলানো ছাড়া বেঁচে থাকা যাবে না। তালিবান এসে গিয়েছে।
গল্প শোনাচ্ছিলেন পাক-আফগান সীমান্ত লাগোয়া আর্গিস্তান জেলার ফলওয়ালা জান আগা। বলছিলেন, নিজেদের পেটে কিছু না পড়লেও সদ্য তালিবানের দখলে যাওয়া প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এখন বাড়তি দু’চারখানা রুটি বানিয়ে রাখে। তারা ভালই জানে, সরকারের শাসন আর নেই। খাবার হোক বা অন্য কিছু, ঘরের বাইরে টহল দেওয়া তালিবান এখন যা চাইবে, জোগাতে হবে। সব কিছু ঠিক তেমনই ঘটছে, যেমন ঘটত গত শতাব্দীতে।
তখর প্রদেশের ইশকামিশ গ্রামের নুরিয়া হায়া যেমন জানেন, আগের মতো কাজের সূত্রে এখন আর পুরুষ ডাক্তারদের সঙ্গে চটজলদি আলোচনা সেরে নিতে পারবেন না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়ার কাজ করেন নুরিয়া। ডাক্তারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকেই। কিন্তু তালিবান এই প্রদেশ কব্জা করার পরেই ফতোয়া দিয়েছে, পুরুষ ও মহিলা কর্মীদের মধ্যে মেলামেশা, বৈঠক বন্ধ! বয়স ২৯, নুরিয়া স্বাভাবিক ভাবেই জীবনে প্রথম বার দেখছেন এমন কাণ্ড। বলছেন, ‘‘প্রায় সমস্ত স্বাধীনতাই হঠাৎ করে চলে গেল। রাস্তায় বেরোলে এখন বোরখা পরতেই হয়। সঙ্গে থাকতেই হয় কোনও না কোনও পুরুষকে। একা আর বেরোনো যাবে না।’’
তখর প্রদেশেই কয়েক দিন আগে ঘটেছে ঘটনাটা। মোটর-রিকশায় বাড়ি ফিরছিলেন মেয়েরা। রাস্তায় তাঁদের থামিয়ে বেতের বাড়ি মেরেছে তালিবান। ওঁরা নাকি ‘পা-খোলা’ চপ্পল পরেছিলেন। ‘গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা’ পোশাক পরার অপরাধে কয়েক দিনে আগে বলখ প্রদেশে ২১ বছরের এক তরুণীকে খুনও হতে হয়েছে। হেরাটের মেয়ে জ়ারা ও তাঁর বোনেরা এক সময়ে স্কুলে যেতেন নির্ভয়ে। এখন সবাই ঘরবন্দি। জ়ারা বলছিলেন, ‘‘এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে যারা পড়াশোনা শিখল কিছু একটা করার তাগিদে, আজ তাদের পক্ষে এ ভাবে ঘরে বন্দি হয়ে থাকা সম্ভব?’’
সবাই বুঝছে, দু’দশকে আফগান মেয়েদের সামনে যে দরজাগুলো খুলেছিল, সেগুলো আবার বন্ধ হতে শুরু করেছে। তালিবান সরকার উৎখাত হওয়ার পরে দৈনন্দিন জনজীবনে ফিরে এসেছিলেন মেয়েরা। পার্লামেন্টে এক-চতুর্থাংশ উপস্থিতি ছিল তাঁদের। দেশে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার হার ৫০ শতাংশে পৌঁছেছিল, সবই এখন অনিশ্চিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস গত কালই বলেছেন, ‘‘অতি কষ্টে আফগান মেয়েরা যে সমস্ত অধিকার অর্জন করেছিলেন, সেগুলো আবার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’’
নিশানা শুধু মেয়েরাই নন। ইতিমধ্যেই বহু এলাকায় পুরুষদের বলে দেওয়া হয়েছে, দাড়ি কামানো বা বিদেশি ফ্যাশনে চুল কাটা, বিদেশি গান শোনাও নিষিদ্ধ। ফিরে আসছে তালিবানের দু’দফা বিচার ব্যবস্থা— প্রথম অপরাধে হুঁশিয়ারি, পরের অপরাধে সাজা। ফিরে আসছে স্কুল বন্ধ করে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার ফতোয়াও। ধর্মীয় অনুদানের নামে টাকা আদায়ও চলছে। তখরের গাড়িচালক আসিফ বলছিলেন, ‘‘তেল কেনার টাকাও জোটে না। আগে লোকে শুক্রবার রাতে পার্টি করত। গান শুনত, নাচত। সবই এখন নিষিদ্ধ।’’ তালিবান নেতাদের দাবি, কাউকেই কিছুতে বাধ্য করছেন না তাঁরা। শোনা যাচ্ছে, কট্টরপন্থীদের সমর্থনও পাচ্ছে তালিবান। আসলে সব তেমনই ঘটছে, যেমন ঘটত গত শতাব্দীতে!