অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ: ইস্তানবুলের স্কুলে উইঘুর পড়ুয়ারা। সোশ্যাল মিডিয়া
জন্মভূমি কেমন, ভুলেই গিয়েছে ন’বছরের ফতিমা। এ বার ভুলতে বসেছে তার বাবাকে কেমন দেখতে, তা-ও।
শুধু ফতিমা একা নয়। ইস্তানবুলে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য উইঘুর শিশু এখন বেড়ে উঠছে অভিভাবক ছাড়া। সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন যে সব উইঘুর মা-বাবা, তাঁদের বেশির ভাগই আর তুরস্কে ফিরে আসেননি।
চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের ৪৫ শতাংশ জনসংখ্যাই উইঘুর মুসলিম। ২০১৭ সালে শি চিনফিং সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ উঠেছিল, অধিকাংশ উইঘুরকে কার্যত বন্দি করে বিশেষ শিবিরে রাখা হয়েছে। বেজিং অবশ্য তখন দাবি করে, এগুলি ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নয়, বৃত্তিমূলক শিক্ষা কেন্দ্র। কিন্তু দেশ ছেড়ে আসা উইঘুরেরা জানিয়েছিলেন, কম পক্ষে ৫০০ ডিটেনশন ক্যাম্প বানিয়েছে বেজিং। অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক চিনা মুসলিমেরই স্থান হয়েছে সেই ক্যাম্পে। আটক উইঘুরের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ বলে জানিয়েছিলেন এই অভিবাসী উইঘুরেরা। তাঁদের সেই দাবি যে অনেকাংশেই সত্য, তা ফের বোঝা যাচ্ছে তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া উইঘুরদের চিনে ফেরামাত্র ‘হারিয়ে যাওয়া’র ঘটনায়।
ঐতিহাসিক ভাবে উইঘুরদের শিকড় তুরস্কে। এই জনগোষ্ঠীর সবাই উইঘুর (তুর্কির একটি উপ-ভাষা) বা তুর্কিভাষী। চিন থেকে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন এই সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। কয়েক শো উইঘুর পরিবার ছেলেমেয়েদের নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় চিন ছেড়ে তুরস্ক চলে এসেছিলেন কয়েক বছর আগে। তুরস্কে শুরু করেছিলেন নতুন জীবন।
তাঁদেরই কয়েক জন গত বছর দেশে ফিরেছিলেন বয়স্ক মা-বাবার খোঁজ নিতে। কেউ বা চিনে ফেলে আসা ব্যবসার খোঁজখবর করতে। সেই ফিরে যাওয়াই বিপদ ডেকে এনেছে এই সব উইঘুরের। চিন থেকে আর ফেরত আসেননি তাঁরা। জানা গিয়েছে, তাঁদেরও ঠাঁই হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তুরস্ক থেকে চিনে ফিরেছেন পুরুষেরা। তাঁরা না-ফেরায় তুরস্কের পরিবারগুলিতে প্রধান রোজগেরে মানুষটির অভাব দেখা দিয়েছে। চরম সঙ্কটে বাচ্চাদের নিয়ে দিন কাটাচ্ছে মা। আর যে পরিবারের মা-বাবা দু’জনেই চিনে ফিরে গিয়েছিলেন, সেখানকার পরিস্থিতি সব থেকে ভয়ঙ্কর। অভিভাবকহীন সন্তানরা ‘অনাথ’ হয়ে আশ্রয় নিয়েছে ইস্তানবুলের প্রান্তে একমাত্র উইঘুর স্কুলে। স্কুলের শিক্ষকেরাই তাদের দেখভাল করছেন।
জিনজিয়াং প্রদেশে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, সেখানকার উইঘুর বাচ্চারাও বেড়ে উঠছে অভিভাবকহীন হয়ে। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ নামের এক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সেপ্টেম্বরে জানিয়েছিল, এই সব অভিভাবকহীন শিশুর বেজিং-নিয়ন্ত্রিত অনাথআশ্রমে স্থান হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না আত্মীয়স্বজনকে।
তবে তুরস্ক উইঘুরদের আশ্রয় দিলেও অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্রের নেতাদের মতো তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এর্ডোয়ান বেজিংয়ের উইঘুর নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জের এক বিশেষ অধিবেশনে এর্দোয়ান কাশ্মীরি মুসলিম ও মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরব হলেও উইঘুরদের নিয়ে কিছুই বলেননি। তবে ইস্তানবুল-সহ তুরস্কের বিভিন্ন শহরে মাঝেমধ্যেই উইঘুরদের সমর্থনে মিছিল বার করেন সাধারণ মানুষ।