ঝাঁ চকচকে রাস্তা, একতলা-দোতলা সমস্ত বাড়ি, পাথর দিয়ে নির্মিত মন্দির। অলিতে গলিতে সাঁতার কেটে গেলে এখনও চোখে পড়ে ড্রাগনের কারুকার্য করা মূর্তি। সবই রয়েছে এই শহরে, শুধু মানুষের দেখা মেলে না। অনেক বছর আগে এক বিশেষ কারণে চিন সরকার জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল এই গোটা শহরকে!
দিনভর কোলাহলমুখর থাকা ওই শহরের নাম ছিল শি চেং। চিনের ঝেজিয়াং প্রদেশের অন্তর্গত ছিল শহরটি। জমজমাট শহরটি ঝেজিয়াঙের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সে সময়। হঠাৎ এমন কী হয়েছিল যাতে গোটা শহরকে ডুবিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল চিন সরকার?
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৫৯ সালে বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। চিন সরকার ঝেজিয়াং প্রদেশের শি চেং শহরের উপকণ্ঠে বাঁধ নির্মাণ করবে স্থির করে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হ্রদের প্রয়োজন। কিন্তু ঝেজিয়াঙে তেমন কোনও হ্রদ ছিল না। বাধ্য হয়ে কৃত্রিম ভাবে হ্রদ বানাতে শুরু করে চিন।
শি চেং শহরটি ছিল ফাইভ লায়ন পর্বতের পাদদেশে। শহরের চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছিল। তাই চিন সরকার সে সময় এই শহরটিকেই হ্রদে পরিণত করার মনস্থির করে। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জিনান নদীকে কেন্দ্র করেই ওই হ্রদ বানানো হয়েছিল।
জল ধরে রাখার জন্য বাঁধ নির্মাণ করে এবং ওই পর্বতের পাদদেশে জল ভরে হ্রদ বানিয়ে ফেলে চিন। এই হ্রদের জলেই নিমজ্জিত হয়ে যায় গোটা শহর। ১৩০ ফুট নীচে তলিয়ে যায় শহরটি।
কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট হ্রদটির নাম রাখা হয় কুইআনদাও হ্রদ। ৬২ বছর ধরে এ ভাবেই জলের তলায় ডুবে রয়েছে শহরটি। রাস্তাঘাট, মন্দির, ঘরবাড়ি সবই রয়েছে আগের মতোই। এই হ্রদের উপর নির্মিত বাঁধটির নাম দেওয়া হয় জিনান।
বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সবুজ সঙ্কেত মেলার পর থেকেই ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছিল শহরের বাসিন্দাদের। এক এক করে সকলকেই নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। শহর পুরোপুরি খালি করে দেওয়ার পর তা জলে ভরে দেওয়া হয়।
চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা থাকায় শহরে জল ভরে ফেলতেও সুবিধা হয়েছিল। হ্রদ তৈরি হওয়ার পর ওই পাহাড়গুলিই এক একটি দ্বীপে পরিণত হয়। দ্বীপগুলির আলাদা নামও রয়েছে।
কোনওটি পক্ষী দ্বীপ, কোনওটি বাঁদর দ্বীপ এবং কোনওটি সাপের দ্বীপ। একটি দ্বীপে গেলে নাকি আবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। হ্রদ জুড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে এমন এক হাজারের বেশি দ্বীপ রয়েছে।
৫৭৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে হ্রদটি। তার মধ্যে মাত্র ৮৬ বর্গ কিলোমিটার অংশ জুড়ে রয়েছে দ্বীপগুলি। জিনান বাঁধই হল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নির্মিত চিনের প্রথম বাঁধ।
শি চেং শহরটির এখন ‘লায়ন সিটি’ নামে পরিচিত। লায়ন পর্বত থেকেই এর নামকরণ। চিনের ‘লায়ন সিটি’ যেন বাস্তবের আটলান্টিস। নিমজ্জিত এই শহরে পর্যটকরাও ঘুরে দেখতে পারেন।