ছবির মতো সাজানো দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট একটা দেশ। সে দেশে বছরের পর বছর ধরে বাস করেন অগণিত ভারতীয়। অথচ এ দেশের আমজনতার প্রায় কেউই খোঁজ রাখেন না তাঁদের। ৫৬ বছর পর সেই আপাত ‘ব্রাত্য’ দেশটিতে পা পড়ল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর। নয়াদিল্লির এই কূটনীতি আগামী দিনে অনেক খেলা ঘুরিয়ে দেবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
ব্রাজিল লাগোয়া ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্র গায়ানা। সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকার ওই দেশটিতে রাজনৈতিক সফরে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁকে সে দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান প্রদান করেছেন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ইরফান আলি। বিমানবন্দরে মোদীকে আলিঙ্গন করে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেও দেখা যায় তাঁকে।
কেন মোদীর গায়ানা সফরকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা? এর নেপথ্যে মূলত ‘তেল অর্থনীতি’ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। কয়েক বছর আগে খনিজ তেলের বিশাল ভান্ডার খুঁজে পায় দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ। আর এর ফলে সেখানকার অর্থনীতি দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে।
দক্ষিণ আমেরিকার তেল উত্তোলনকারী দেশগুলির মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ২০২৬ সালের মধ্যে ‘তরল সোনা’ উৎপাদনের নিরিখে কারকাসকে ছাপিয়ে যাবে গায়ানা। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববাজারে খনিজ তেলের সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে ব্রাজিলের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
‘তরল সোনা’ রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ‘ওপেক’-এর (অর্গানাইজ়েশন অফ পেট্রলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ়) বাইরে অন্যতম তেল উত্তোলক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার সব রকমের সম্ভাবনা গায়ানার মধ্যে রয়েছে। গত দু’তিন বছরে অস্বাভাবিক উচ্চতায় এর জিডিপিকে উঠতে দেখা গিয়েছে। ২০২০ এবং ২০২১ সালে গায়ানার আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে যা ৬২ শতাংশে পৌঁছে যায়। ২০২৩ সালে সূচক কিছুটা নেমে ৩৩ শতাংশে থেমেছিল।
২০১৫ সালে তেলের খনি খুঁজে পায় গায়ানা প্রশাসন। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির মাটির নীচে রয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি ব্যারেল ‘তরল সোনা’। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী খনিজ তেলের ১৮ শতাংশের মালিক গায়ানা সরকার। ২০২১ সাল থেকে লাফিয়ে বেড়েছে এর তেল রফতানি। ওই বছর দিনে এক লক্ষ ব্যারেল করে অপরিশোধিত তেল বিক্রি করেছিল দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ।
গায়ানার তেল রফতানির পরিমাণ তিন থেকে চার বছরের মধ্যে প্রায় ন’গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০২৭ সালে দেশটির দৈনিক ‘তরল সোনা’ বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ন’লক্ষ ব্যারেল।
অন্য দিকে, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারী দেশ হল ভারত। আর তাই গায়ানার সঙ্গে তেল চুক্তি সেরে ফেলতে দীর্ঘ দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র ইংরেজিভাষী দেশটির ‘তরল সোনা’র অংশীদারি পাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে মোদী সরকার।
বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরের গোড়ায় গায়ানার প্রাকৃতিক সম্পদমন্ত্রী বিক্রম ভরতের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন ভারতের পেট্রলিয়ামমন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরী। পরে বিক্রম বলেন, ‘‘নয়াদিল্লির সঙ্গে অপরিশোধিত তেল নিয়ে কোনও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা যায় কি না, তা নিয়ে আমরা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেব।’’
ভারতীয় তেল সংস্থাগুলি গায়ানায় পেট্রলিয়াম অনুসন্ধানে আগ্রহী। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির সরকার এ ব্যাপারে নিলাম করতে আগ্রহী। অন্য দিকে, নিলামের বদলে আলোচনার মাধ্যমে এই সুবিধা পেতে চাইছে নয়াদিল্লি।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের পেট্রলিয়াম মন্ত্রকের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি (মউ) করেছে গায়ানার প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রক। সেখানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে অপরিশোধিত তেলের অনুসন্ধান এবং পরিশোধনে ভারতীয় সংস্থাগুলির যুক্ত থাকার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
আগামী দিনে গায়ানা নয়াদিল্লির অন্যতম বড় প্রতিরক্ষা বাজার হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি এই দেশটিকে দু’টি ‘ডর্নিয়ার-২২৮’ বিমান উপহার দিয়েছে মোদী সরকার। সেগুলির নির্মাণকারী সংস্থা ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ (হ্যাল)। তার পর থেকেই ভারতের হাতিয়ার কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে গায়ানা।
এ ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে প্রভূত লাভের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করে এ দেশের ফার্মা, বায়ো ফুয়েল, এনার্জি এবং সংকর ধাতু নির্মাণকারী সংস্থা। আড়াই কোটি ডলার ব্যয়ে জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি করছে গায়ানা। এই কাজও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
পাশাপাশি, ৫০টি সৌরশক্তিচালিত ট্র্যাফিক আলো, পয়ঃপ্রণালী ঠিক রাখার পাম্প এবং জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র নির্মাণে গায়ানাকে আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করছে মোদী সরকার। কোভিড অতিমারির সময় ভারত দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশে টীকা পাঠিয়েছিল।
খনিজ তেলের ভান্ডারে পরিপূর্ণ এ হেন গায়ানার দিকে নজর রয়েছে চিনেরও। বেজিং ইতিমধ্যেই সেখানে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প শুরু করে দিয়েছে। পাল্টা রাজধানী জর্জটাউনের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছে নয়াদিল্লি। এর জন্য ১০ কোটি টাকা খরচ করতেও পিছপা হয়নি ভারত।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব বাজারে তেলের দর হু-হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মস্কোর থেকে সস্তা দরে তরল সোনা আমদানি করছে নয়াদিল্লি। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে তেলের ব্যাপারে অন্য জানালাও খোলা রাখতে চাইছে কেন্দ্র।
গায়ানা ছাড়া ভেনেজুয়েলা থেকেও অপরিশোধিত তেল কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ভারত। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার জেরে তা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করা যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
বর্তমানে গায়ানার ৪৩.৫ শতাংশ জনগণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, মোট ৩.২ লাখ ভারতীয় বংশোদ্ভূত থাকেন দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশে। পরাধীন থাকাকালীন যাঁদের পূর্বপুরুষদের এক রকম দাস হিসাবে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকেরা।