চিনের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই চিনের প্রাচীরের কথা মাথার আসে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য ২১ হাজার ১৯৬ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল এই প্রাচীর। তেমনই আর এক রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে চিন। এ বার আরও এক প্রাচীর গড়ে তুলতে চলেছে চিন।
১২ লক্ষ ৯৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে থাকা এশিয়ার অন্যতম বড় মরুভূমিকে জঙ্গলে পরিণত করতে চলেছে চিন! মরুভূমির অনেকটা অংশ জুড়ে গড়ে তুলবে এই সবুজ প্রাচীর। সেই লক্ষ্যে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছে চিন। ২০০৯-এর হিসাব অনুযায়ী, মরুভূমির যেটুকু অংশে জঙ্গলে পরিণত হয়ে গিয়েছে সেই হিসেব কষলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানুষ নির্মিত অরণ্য এটিই। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন মরুভূমিকে জঙ্গলে পরিণত করছে চিন?
চিনের উত্তরাঞ্চলের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে এই মরুভূমি। চিনের জলবায়ুর উপরে মরুভূমির বিরূপ প্রভাব প্রকট হয়ে উঠত মূলত মার্চ এবং এপ্রিল মাসে।
এ সময় মরুধুলোয় ঢেকে যেত উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানী বেজিং পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা। বছরের এই দু'মাস নিজেদের সম্পূর্ণ না ঢেকে বাইরে বার হতেই পারতেন না কেউ। যানবাহন চলাচল থেকে বিমানের ওঠানামাও বাধার মুখোমুখি হত।
অন্য দিকে মরুভূমির আকারও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর গোবি মরুভূমি অন্তত ৩৬০০ বর্গ কিলোমিটার ঘাসজমি দখল করে নিচ্ছে। মরুঝড়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মাটির উপরের অংশ।
শুধু চিনের গোবি মরুভূমি সংলগ্ন অঞ্চলই নয়, প্রতিবেশী দেশ জাপান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে এই মরুঝড়। এই সমস্ত দেশের চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য।
এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭৮ সালে ‘সবুজ দেওয়াল’ (গ্রিন ওয়াল) নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে চিন সরকার। গোবি মরুভূমির বুকে ‘সুবজ বিপ্লব’ ঘটায় চিন।
গাছ বসিয়ে সবুজ প্রাচীর গড়ে তুলে মরুঝড় আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মরুভূমির আগ্রাসনকে রোখার চেষ্টাও করছে এই ভাবে।
ইতিমধ্যেই যার ফলে মরুভূমির ৫ থেকে ১৫ শতাংশ অঞ্চল অরণ্যে পরিণত করে দিতে পেরেছে চিন। সব কিছুকে গ্রাস করতে আসা মরুভূমিকেও রুখে দিতে পেরেছে অনেকটাই।
গোবি মরুভূমি অত্যন্ত শুষ্ক অঞ্চল। চাষাবাদ করাই যেখানে দুঃসাধ্য, সেখানে আস্ত জঙ্গল তৈরি অসম্ভব ছিল। সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছে চিন।
এমন অতি শুষ্ক পরিবেশে গাছপালাতে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল চিনের সামনে। তাতে উত্তীর্ণও হয়েছে তারা।
কী ভাবে সম্ভব হল এই কাজ? চিন সরকার এর জন্য দু'টি উপায় বার করেছে। এক, হেলিকপ্টার বা ড্রোনে করে উপর থেকে বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে। যাতে বিশাল এলাকা জুড়ে প্রচুর পরিমাণ বীজ একসঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
দুই, ওই অঞ্চলের আশেপাশে থাকা কৃষকদের গাছ লাগানোর উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ধার্য করে দিয়েছে। গাছ পিছু টাকা পান তাঁরা।
এতে গাছ লাগানো এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান কৃষকরাও। পাশাপাশি পড়ুয়াদের স্কুল প্রজেক্টের একটি অংশে এই অঞ্চলের দেখাশোনার বিষয় যোগ করে দেওয়া হয়েছে। আশপাশের স্কুল থেকে পড়ুয়াদের এখানে আনা হয়। তার পর তারা গাছে জল-সার দিয়ে যত্ন নেয়।
২০০৯ সাল পর্যন্ত মরুভূমির পাঁচ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গাছ বসিয়ে দিয়েছিল চিন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম বনভূমি এটিই।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে মরুভূমিকে জঙ্গলে পরিণত করার বিষয়টি প্রশংসনীয় লাগলেও চিনের কৌশলে কিন্তু গলদ রয়েছে।
সমস্যার আশু সমাধানে চিন এমন সমস্ত গাছ ওই অঞ্চলে রোপণ করছে, যেগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মূলত একই ধরনের গাছ লাগাচ্ছে তারা। এতে বেশ কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
এক, ওই সমস্ত গাছগুলির শিকড় মাটির অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়ে। গভীর থেকে ভূগর্ভস্থ জল শোষণ করে নিচ্ছে তারা। যার প্রভাব পড়ছে চাষাবাদে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। জলের সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করছে।
দুই, একই ধরনের যে সমস্ত গাছ লাগিয়ে জঙ্গল বানাচ্ছে চিন, সেগুলিতে খুব বেশি ডালপালা নেই। ফলে পশু-পাখি বাসা বাঁধতে পারছে না। জঙ্গলের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের অভাব দেখা গিয়েছে এ ক্ষেত্রে।
তিন, এতে জঙ্গলের লুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। কারণ, যেহেতু একই ধরনের গাছ রয়েছে সেখানে, তাই কোনও একটি রোগেই সমস্ত গাছ মারাও যেতে পারে।
২০৫০ সাল পর্যন্ত এই ভাবেই সবুজ প্রাচীর গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যাবে চিন। আট কোটি ৮০ লক্ষ একর এলাকা জুড়ে প্রসারিত থাকবে এই অরণ্য, পরিকল্পনা এমনই।