পেরুর আমাজনের গভীরে বইছে সে। ফুটন্ত নদীর জল। তার ভিতরে যা পড়ে সব কিছুকে গ্রাস করে নেয় সেই নদী। ইনকাদের কাছে সেই নদী ছিল সূর্যদেবের জলস্রোত। সূর্যের তাপেই ফুটত নদীর জল— বিশ্বাস ছিল প্রাচীন এই জনজাতির।
নিজেদের কথ্য ভাষায় সূর্যদেবের উপাসক ইনকারা এই জলস্রোতের নাম দিয়েছিল ‘শানায় টিম্পিসখা’। স্পেনীয় বাহিনী, যাঁরা ইনকা সভ্যতা জয় করার জন্য অভিযানে সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের বিবরণেও আছে এই নদীর কথা।
কিন্তু কী ভাবে এই নদীর জল সবসময় ফুটতে থাকে, তার উত্তর বহু বছর ছিল অজানা। আরও অনেকের মতো লোককথা রূপকথার এই নদীর কথা শুনেছিলেন আন্দ্রে রুজোও। তখন তিনি পেরুর রাজধানী লিমার বাসিন্দা। কিশোর আন্দ্রে ভেবেছিলেন, বড় হয়ে তিনি এই নদীর রহস্যভেদ করবেন।
কৈশোর থেকে শুরু করে টানা ১২ বছর ধরে এই নদীর অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন আন্দ্রে। দশক পেরিয়ে পেরুর ছেলে আন্দ্রে গেলেন টেক্সাস। সাদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হতে। বিষয় ছিল, জিয়োফিজিক্স।
কোর্স চলাকালীন আবার আন্দ্রের মনে ফিরে আসে কৈশোরের স্বপ্ন। বার করতে হবে ফুটন্ত নদীর রহস্য। তৈরি করেন পেরুর থার্মাল-ম্যাপ বা তাপমানচিত্র। পেরু জুড়ে বিস্তৃত জিয়ো থার্মাল বৈশিষ্ট তাঁকে বিস্মিত করে।
ধীরে ধীরে আন্দ্রে বুঝতে পারেন ফুটন্ত নদীর অস্তিত্ব আছে। এবং সে নদী সূর্যদেবের তাপে নয়। ফুটছে পৃথিবীর ভূভাগের অভ্যন্তরস্থ তাপে। নিজের চোখে রহস্যভেদ করতে ২০১১-র নভেম্বরে পেরুর মধ্য অংশে অভিযানে গেলেন আন্দ্রে।
শানায়া টিম্পিসখা নদীর নিকটবর্তী শহর হল পুকালপা। সেখান থেকে শুরু হল আন্দ্রের যাত্রা। দু’ঘণ্টা গাড়িতে, এক ঘণ্টা যন্ত্রচালিত ডিঙি-র পরে আরও ঘণ্টা খানেক ঘন আমাজনের কাদাপথে ট্রেকিং। তার পরে দেখা মিলল ফুটন্ত নদীর।
কিন্তু শেষ মুহূর্তেও বাধা। নদীর কাছেই আছে মায়ানটুয়াকু গ্রাম। সেই গ্রামের পুরোহিতরা নদীর কাছে যেতে দেন না বহিরাগতদের। কারণ ওই নদীর জল তাঁরা ব্যবহার করেন ওষধি হিসেবে। ফলে তার হদিশ রাখতে চান গোপনই।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে স্থানীয় পুরোহিত বা শামানকে বোঝালেন আন্দ্রে। অনেক সাধ্যসাধনার পরে মিলল নদীর কাছে যাওয়ার অনুমতি। কিন্তু একা নয়। পুরোহিত তাঁর সঙ্গে দিয়ে দিলেন নিজের প্রতিনিধিকে। তিনি আগাগোড়া আন্দ্রের সঙ্গে থাকলেন।
ছয় মাইল লম্বা এই নদীকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ঘন গাছের সবুজ প্রাচীর। নদীর সর্বোচ্চ গভীরতা ১৬ ফুট পর্যন্ত। উষ্ণ প্রস্রবণের মতো নিজের খেয়ালেই সে বেরিয়েছে পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক দিয়ে। তারপর নিজের যাত্রাপথ শেষ করে সে মিশে গিয়েছে আমাজনের সঙ্গে।
নদীর জলের সর্বোচ্চ উষ্ণতা পৌঁছয় ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত। আন্দ্রে দেখতে পান, ধোঁয়া ওঠা ফুটন্ত সেই স্রোত বেয়ে ভেসে চলেছে প্রাণীদের ঝলসে যাওয়া দেহ। সবথেকে বীভৎস লেগেছে আন্দ্রের কাছে, মৃত প্রাণীগুলির চোখ গলে সাদা হয়ে গিয়েছে।
বিরল হলেও ফুটন্ত নদী আরও আছে পৃথিবীতে। কিন্তু সেগুলির কাছে হয় আগ্নেয়গিরি বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আছে। আমাজনের শানায় টিম্পিসখা নদী থেকে নিকটবর্তী সক্রিয় আগ্নেয়গিরির দূরত্ব ৪০০ কিমি। তা ছাড়া পেরুর আমাজনে কোনও চৌম্বকীয় ক্ষেত্রও নেই।
তা হলে এই নদীর জল ফুটন্ত হল কী করে? আন্দ্রে ও তাঁর সহকারী গবেষকদের মত, এর কারণ ভূগহ্বরের তাপমাত্রা। তাঁদের মতে, পেরুর আমাজন অরণ্যের এই গভীরে শিলাময় ভূভাগে চ্যুতি বা ফাটল অনেক বেশি। সেখান দিয়ে বৃষ্টির জল প্রবেশ করে ভূভাগের ভিতরে।
তার পর আবার ওই জলধারা উঠে আসে ভূভাগের উপরে। তখন তার তাপমাত্রা বেড়ে যায় কয়েকশো গুণ। অর্থাৎ জিয়োথার্মাল বা হাইড্রোথার্মাল চক্রের বিক্রিয়াই ফুটন্ত নদীর রহস্য।
নিজের অভিজ্ঞতা আন্দ্রে লিখেছেন ‘দ্য বয়েলিং রিভার: অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ডিসকভারি ইন আমাজন’ বইয়ে। তাঁর আবেদন, ফুটন্ত নদীর বিস্ময়কে বাঁচাতে আমাজন অরণ্যে বৃক্ষনিধন বন্ধ হোক।