ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে আল-জ়াওয়াহিির। গেটি ইমেজেস
উনি পিএইচ ডি। ইনি চোখের সার্জন। অথচ কুখ্যাত দুই জঙ্গি নেতা হিসেবেই আমৃত্যু তাঁদের চিনল দুনিয়া।
দু’জনের মৃত্যুও বেঘোরে। প্রথম জন, ইসলামিক স্টেটের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি সিরিয়ায় আমেরিকান সেনার অভিযানে কোণঠাসা হয়ে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। সেই আমেরিকারই ড্রোন হানায় কাবুলে মৃত্যু দ্বিতীয় জন, আয়মান মহম্মদ রাবি আল-জ়াওয়াহিরির। কোথায় যেন মিলে গেল দুই জঙ্গি নেতার জীবনের গতিপথ। মেধাবী, অথচ পথভ্রষ্ট।
বাড়িতে কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষাবিদ, কেউ কাজ করেছেন কূটনৈতিক উচ্চ পদে। মিশরের কায়রোর এমনই এক পরিবারের সন্তান জ়াওয়াহিরি। ঠাকুরদা রাবিয়া আল-জ়াওয়াহিরি ছিলেন কায়রোর বিখ্যাত আল-আজহার মসজিদের গ্র্যান্ড ইমাম। এক কাকা ছিলেন আরব লিগের প্রথম মহাসচিব। বাবা মহম্মদ কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের ফার্মাকোলজির অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডাক্তারি পাশ করেন জ়াওয়াহিরি। চার বছর পরে শল্যচিকিৎসায় স্নাতকোত্তরও।
মগজে কট্টরপন্থা ঢুকে গিয়েছিল অবশ্য কৈশোরেই। ‘নিষিদ্ধ’ মুসলিম ব্রাদারহুডে নাম লিখিয়ে ১৫ বছর বয়সেই জ়াওয়াহিরি প্রথম বার গ্রেফতার হন। ডাক্তারি পাশ করে সেনাবাহিনীতে তিন বছর কাজ করার পরে কায়রোতে ডাক্তারখানা খোলেন। কিন্তু মিশরের সরকার ফেলে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে যেই ‘ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ’ প্রতিষ্ঠা হল, জ়াওয়াহিরিও তাতে যোগ দিয়ে ফেললেন।
আনোয়ার আল-সাদাত তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট। ১৯৮১ সালে সামরিক কুচকাওয়াজে ছদ্মবেশী জঙ্গিরা খুন করল তাঁকে। ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদের কয়েকশো সদস্যের সঙ্গে গ্রেফতার হলেন জ়াওয়াহিরিও। সাদাত-খুনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেও বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগে জ়াওয়াহিরির তিন বছরের জেল হয়। পরে কিছু সহ-বন্দি বলেছেন, জেলে প্রচণ্ড অত্যাচার হয়েছিল জ়াওয়াহিরির উপরে। কার্যত ওই তিনটে বছরই তাঁকে ডাক্তার থেকে বদলে দেয় উগ্র ধর্মান্ধ এক চরমপন্থীতে।
১৯৮৫-তে জেল থেকে বেরিয়ে জ়াওয়াহিরি চলে যান সৌদি আরবে। সম্ভবত ঠিক পরের বছরেই ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা। কেউ কেউ বলেন, সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে আহত মুজাহিদদের চিকিৎসা করতে সেই সময়ে পাক-আফগান সীমান্তে গিয়েছিলেন জ়াওয়াহিরি। বিন লাদেন তখনও আল কায়দা গঠন করেননি। জ়াওয়াহিরি দ্রুত তাঁর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। সঠিক সময়টা জানা যায় না, তবে ক্রমশ বিন লাদেনের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পাশাপাশি তাঁর মুখ্য পরামর্শদাতার দায়িত্বও জ়াওয়াহিরির কাঁধে এসে পড়ে। ইঙ্গিত ছিল তখনই, তিনিই হয়ে উঠবেন বিন লাদেনের ‘ডান হাত’।
১৯৯৩ সালে ইজিপশিয়ান ইসলামিক জেহাদের প্রধান হন জ়াওয়াহিরি। পাঁচ বছর পরে সেই গোষ্ঠীকে আল কায়দার সঙ্গে জুড়ে দেন তিনি। সেই ১৯৯৮ সালেই কেনিয়ার নাইরোবি ও তানজ়ানিয়ার দার এস সালামে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরণে ২২৪ জন মারা যান। আঙুল ওঠে জ়াওয়াহিরির দিকেই। আল কায়দার ভয়ঙ্করতম হামলা অবশ্য তখনও বাকি। ৯/১১। ২০০১ সালে আমেরিকায় ছিনতাই করা চারটি বিমান আছড়ে ফেলে তিন হাজার মানুষের মৃত্যুর ষড়যন্ত্রী হিসেবে যাঁদের দিকে আঙুল উঠেছিল, জ়াওয়াহিরি তাঁদেরই অন্যতম।
৯/১১-র পরে আমেরিকার অভিযানে আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের পতন ঘটে। শোনা যায়, বিন লাদেন এবং জ়াওয়াহিরি তখন আফগানিস্তানেই গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন। মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে আসত তাঁদের অডিয়ো বা ভিডিয়ো টেপ। তবে বিন লাদেনের চেয়ে ভিডিয়োয় বেশি দেখা যেত জ়াওয়াহিরিকেই। ২০০৭ সালে তাঁর এমন ১৬টি অডিয়ো ও ভিডিয়ো ফাইল পাওয়া গিয়েছিল। তালিবানের এক শীর্ষ নেতার দাবি, ওই সময়ে হেলমন্দ প্রদেশের দুর্গম পাহাড়ে থাকতেন জ়াওয়াহিরি। মাঝে মাঝে চলে যেতেন পাক সীমান্ত এলাকায়। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের জনজাতি অধ্যুষিত এক গ্রামে জ়াওয়াহিরির উপস্থিতির আঁচ পেয়ে হামলা চালিয়েছিল আমেরিকার ড্রোন। তিনি বেঁচে গেলেও মারা গিয়েছিলেন ১৮ জন গ্রামবাসী।
আল কায়দার দু’নম্বর নেতা তিনি ছিলেনই। ২০১১-এ আমেরিকান বাহিনীর অভিযানে বিন লাদেন নিহত হওয়ার পরে প্রত্যাশিত ভাবেই জ়াওয়াহিরি আল কায়দার প্রধান হন। মাঝেমধ্যেই ভিডিয়ো-অডিয়ো বার্তা দিতেন। কাশ্মীর প্রসঙ্গও এসেছে সেই বার্তায়। তবে অনেকে বলেন, বাগদাদির ইসলামিক স্টেট নৃশংসতায় জ়াওয়াহিরির আল কায়দাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।
২০০৬-এ আমেরিকার ড্রোন হানা থেকে বেঁচে যাওয়ার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের উদ্দেশে জ়াওয়াহিরি বলেছিলেন, ‘‘আপনি বা সারা বিশ্বের শক্তি মিলেও আমার মৃত্যু এক সেকেন্ড এগিয়ে আনতে পারবেন না।’’ পাহাড়ি ডেরায় নয়, কাবুলের অভিজাত পাড়ায় সেই আমেরিকার ড্রোনই মুছে দিল পথভ্রষ্ট ডাক্তারকে।