কোথাও ঘুরতে গেলে আমরা অনেকেই সেই জায়গাটিকে মনে রাখার জন্য কোনও কিছু কিনে আনি। সেটা চাবির রিং-ই হোক কিংবা একটা সামান্য পেন! অনেকে আবার এগুলি উপহারও দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই উপহার দেওয়া পেন যদি হয় ২০০০ বছরের পুরনো, তা হলে?
এমনই বেশি কিছু পেনের সন্ধান পাওয়া গেল লন্ডনে, ব্লুমবার্গের ইউরোপিয়ান হেডকোয়ার্টারে। ২০১০ সালে খননকার্য চলাকালীন পাওয়া যায় ১৪ হাজার শিল্পকর্ম, তাদেরই মধ্যে অন্যতম এই পেন, যার বয়স প্রায় ২০০০ বছর।
পেন বলা হলেও, আমাদের পরিচিত পেনের সঙ্গে কিন্তু এর মিল কম। ‘স্টাইলাস’টি এই সময়ের পেনের মতো কেবল দেখতেই, যা তৈরি হয়েছে লোহা দিয়ে। প্রাচীন কালে প্যাপিরাসে ও মোমের আস্তরণ যুক্ত কাঠের ট্যাবলেট এবং শিলালিপিতে লেখার কাজে ব্যবহৃত হত এই স্টাইলাস।
তবে এই পেনের গুরুত্ব শুধু তাঁর বয়সকালের জন্যই নয়, পেনের উপর খোদাই করা লেখা নজর কেড়েছে সবার। ২০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হওয়া মোট দুশো স্টাইলাস উদ্ধার করা হলেও তাঁর মধ্যে কেবল চারটি স্টাইলাসেই লেখা ছিল তাঁর প্রাপকের উদ্দেশে একটি বার্তা।
এই স্টাইলাসে লেখা ছিল, ‘আমি শহর থেকে এসেছি। তোমাকে স্বাগত জানানোর জন্য একটি উপহার নিয়ে এসেছি, যার মুখটি খুবই তীক্ষ্ণ। এই তীক্ষ্ণ মুখ আমার কথা তোমায় মনে করাবে। যদি ভাগ্য সহায় হয়, আশা করি এ রকম আরও উপহার দিতে পারব। তবে দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে এই মুহূর্তে আমার সঙ্গতি না থাকায় এর থেকে বেশি কিছু দেওয়া সম্ভব নয়।’
কবিতার ভাষায় মজার ছলেই উপহার গ্রহণকারীকে দাতা বলেছেন যে, ‘পকেটে টাকা না থাকায় সামান্য একটি পেনই উপহার দিলাম আমি খোদাই করে।’ ২০০০ বছর আগে রোমানদের মধ্যে যে এত ভাল কৌতুক বোধ ছিল তা দেখে অবাক বিশেষজ্ঞরা ।
লেখাটি পড়ে বোঝা যায় যে, ওই ব্যক্তি রোম থেকে লন্ডন দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে এসেছিলেন এবং সেই রাস্তা পেরোতে গিয়ে তাঁর সমস্ত টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে। বন্ধুদের উপহার দেওয়ার জন্য বেশি টাকা না থাকায় এই পেনেই তিনি টাকা না থাকার বিষয়টি মজার ছলে উল্লেখ করেছেন।
তবে এই পেন বা স্টাইলাসে কী লেখা ছিল, তা পড়া মোটেও সহজ ছিল না। ২০০০ বছর পুরনো এই স্টাইলাসে ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় তাঁকে সংরক্ষণ করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল। গবেষকরা বেশ কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় এই পেনগুলিকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
লন্ডনের ব্লুমবার্গ অফিসের ইউরোপিয়ান হেডকোয়ার্টারের মাটির তলা থেকেই পাওয়া যায় এই রোমান শিল্পকর্মগুলি। এর পিছনেও রয়েছে এক ইতিহাস। বর্তমান লন্ডনের ওয়ালব্রুক স্ট্রিটে ১৯৫৪ সালে খননকার্য চলাকালীন খোঁজ মেলে একটি রোমান মিথ্রাউমের।
মিথ্রাউম হল রোমান দেবতা মিথ্রাসের উপাসনালয়। তৃতীয় শতাব্দীর মধ্য ভাগে তৈরি এই উপাসনালয়টি আসলে একটি গির্জা যা রোমান দেবতা মিথ্রাস ও তার যোদ্ধাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। চতুর্থ শতাব্দীতে এটি বাকাসের উপাসনার জন্য অর্পিত হয়।
বাকাস বা ডিয়োনিসাসকে আঙুরের দেবতা হিসাবে পুজো করা হত। এই উপাসনালয়ের নীচেই চাপা দেওয়া ছিল সাদা মার্বেলের তৈরি রোমান দেবতা মিনার্ভা, মারকিউরি যিনি মৃত আত্মাদের ঈশ্বর নামেও পরিচিত এবং মিথ্রাস ও সেরাপিসের মূর্তি।
মিথ্রাউমটি আবিষ্কার হওয়ার পর গবেষকরা ১৮৮৯ সালে খুঁজে পাওয়া বেশ কিছু রোমান শিল্পকর্ম যে ওই মিথ্রাউমেরই অংশ, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হন। আরও জানা যায় যে, এই রোমান উপাসনালয়টি ওয়ালব্রুক নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত ছিল, রোমানদের জলের প্রয়োজন মিটত এই নদীর মাধ্যমেই।
১৯৫৪ সালে বাকলার্সবেরি হাউস তৈরি করার সময় এই মিথ্রাউমটি খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাকলার্সবেরি হাউস জায়গা ছাড়তে না চাওয়ায় এই মিথ্রাউমটিকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৬২ সালে ১০০ মিটার দূরে টেম্পল কোর্টে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ‘ওপেন এয়ার পাবলিক ডিসপ্লে’ হিসাবে রাখা হয় এটি।
২০১০ সালে ওয়ালব্রুক স্ট্রিট ব্লুমবার্গ কোম্পানি কিনে নেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় মিথ্রাউমকে তাঁর পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে আনার। বর্তমানে ব্লুমবার্গ অফিসের প্রদর্শনীর অংশ হিসাবেই রয়েছে এই মিথ্রাউমটি, যা মাটি থেকে ৮ মিটার নীচে অবস্থিত।