অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ৪ মার্চ, ১৮৭৯ জার্মানির উলমা শহরে জন্ম। বাবা ছিলেন হারমান আইনস্টাইন আর মা পাওলিন। স্কুল শেষ করে জুরিখের পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করেন অ্যালবার্ট। সে বছরই সেনায় বাধ্যতামূলক ভর্তি এড়াতে জার্মান নাগরিকত্ব ছেড়ে দেন। বয়স তখন ১৭।
১৯০৫ সাল ছিল আইনস্টাইনের জীবনের বিস্ময়কর বছর। একই বছরে তাঁর তিনটি পেপার প্রকাশ পায়। প্রথম পেপারে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের ভিত তৈরি। দ্বিতীয় পেপারে ব্রাউনিয়ান মোশন থেকে অনুর অস্তিত্ত্ব শনাক্ত করা। আর তৃতীয় পেপারে আলোর কণা কোয়ান্টামের প্রয়োগ, যার সূত্রে আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কার।
আইনস্টাইন প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন ১৬ বছর বয়সে। প্রথম প্রেমিকা ছিলেন মারি ভিন্টেলার। আলবার্টের চেয়ে দু’বছরের বড়, সদ্য কলেজে শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায়। জুরিখ থেকে পঁচিশ মাইল পশ্চিমে, আরাউ গ্রামে আলবার্ট তখন ভিন্টেলার পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন।
প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর অ্যালবার্ট জুরিখ পলিটেকনিকের ছাত্রী মিলেভা মারিচের প্রেমে পড়েন। আইনস্টাইনের ক্লাসের একমাত্র মেয়ে ছিলেন তিনি। বয়সে তিন বছরের বড়। কোমরে হাড়ের সমস্যা, শারীরিক ভাবেও দুর্বল ছিলেন। প্রথম প্রেমিকা, মারির মতো অত সুন্দরী ছিলেন না মিলেভা। কিন্তু অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যায় ওঁর ঘোর প্যাশনে প্রেমে পড়েছিলেন অ্যালবার্ট।
অ্যালবার্টের মা পাওলিনে কিন্তু মিলেভাকে একেবারেই পছন্দ করেননি। দীর্ঘ টানাপড়েনের পড়ে তাঁদের বিয়ে হয়। কিন্তু তার আগেই মিলেভা ও আইনস্টাইনের একটা কন্যা সন্তান হয়। বিয়ের পর আরও দুই ছেলে হয় তাঁদের। কিন্তু তত দিনে তাঁদের প্রেমের সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। তাঁরা তখন দু’জনে প্রাগ শহরে বাস করতেন।
সম্পর্কের এই কঠিন সময়ে ইস্টারের ছুটি কাটাতে এসে আইনস্টাইনের নতুন করে দেখা হয় তিন বছরের বড় খুড়তুতো দিদি এলসার সঙ্গে। এলসা ছিলেন সুন্দরী ও ঘরোয়া। দীর্ঘ দিন এলসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আইনস্টাইনের। মিলেভার সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর খুড়তুতো দিদি এলসাকেই তিনি বিয়ে করেন। বাকি জীবনটা তাঁর সঙ্গেই কাটিয়েছিলেন।
বিশ্বের রহস্যমোচনে তাঁর অবদান অনেক। অনেক কঠিন বিষয়ের সহজ সমাধান করে ফেলতেন তিনি। কিন্তু প্রবাদপ্রতিম এই পদার্থবিদের জীবনে একটা বড় দুঃখ রয়ে গিয়েছিল। নিজের ছেলেরই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি তিনি।
মিলেভা ও আইনস্টাইনের মোট তিন সন্তান ছিল। বিয়ের আগে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম লিজেরল। মিলেভার বাবা-মার কাছেই লিজেরল থাকত। কিন্তু পরে তার কী হয়েছিল তা জানা যায়নি। বিয়ের পরে মিলেভা আরও দুই পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। হ্যানস অ্যালবার্ট এবং এডুয়ার্ড।
ছোট ছেলে এডুয়ার্ডকে নিয়েই শেষ জীবনে খুব মানসিক অশান্তির মধ্যে কাটিয়েছেন অ্যালবার্ট। এডুয়ার্ড ছোট থেকেই খুব দুর্বল ছিলেন। প্রচুর চিকিৎসাও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার থেকেও ছেলে এডুয়ার্ডের জন্য আরও ভয়ানক অসুখ অপেক্ষা করে ছিল। মাত্র ২০ বছর বয়সে এডুয়ার্ড স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন।
ছেলেকে টিটি বলে ডাকতেন অ্যালবার্ট। কবিতা, পিয়ানো এবং মনোরোগবিদ্যায় ভীষণ কৌতুহল ছিল এডুয়ার্ডের। বাবার মতো তিনিও জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাবার মতো তিনিও ক্লাসে তাঁর চেয়ে বড় এক মহিলার প্রেমে পড়েন।
খুব খারাপ পরিণতি হয়েছিল সম্পর্কটার। একেবারেই মেনে নিতে পারেননি এডুয়ার্ড। মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, ১৯৩০ সালে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। তারপরই ধরা পড়ে, তিনি স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে ছিল। কঠিন চিকিৎসায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।
১৯৩৩ সালে পরিস্থিতির শিকার হয়ে আইনস্টাইনকে আমেরিকায় চলে যেতে হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন, দুই ছেলেও যাতে তাঁর কাছে আমেরিকায় চলে আসেন। কিন্তু ছেলেকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। ছেলের এই করুণ পরিস্থিতি একেবারেই মানতে পারছিলেন না অ্যালবার্ট। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
এডুয়ার্ডের পরবর্তী জীবন জুরিখের ওই মানসিক হাসপাতালেই কেটেছিল। আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর থেকে আর এক বারের জন্যও জুরিখে ফিরতে পারেননি আইনস্টাইন। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। তবে যত দিন বেঁচে ছিলেন, ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠাতেন।
হঠাৎ হঠাৎই কাগজ কলম নিয়ে বিশ্বের রহস্যমোচনে ব্যস্ত হতেন অ্যালবার্ট। ছেলের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ১৯৫৫ সালে ৭৬ বছর বয়সে কাজ করতে করতেই মৃত্যু হয় আইনস্টাইনের। তার ১০ বছর পর ১৯৬৫ সালে ওই মানসিক হাসপাতালেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৫৫ বছরের এডুয়ার্ড।