পঞ্জশিরে তালিবানের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ। -ছবি টুইটারের সৌজন্যে।
লড়তে জানে পঞ্জশির! হারতে জানে না। সেটা সম্ভবত বুঝে ফেলেছে রাশিয়া! তাই রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বৃহস্পতিবার মস্কোয় সাংবাদিকদের বলেছেন, “আফগানিস্তানে তালিবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুধু পঞ্জশির উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ। তাই গোটা আফগানিস্তান তালিবদের নিয়ন্ত্রণে বলা যাচ্ছে না।”
ঘটনা হল, মাথা নোয়াতে জানে না হিন্দুকুশ পর্বতমালার কোলে পঞ্জশির উপত্যকা। ইতিহাস বলছে, পঞ্জশির বার বার দেখিয়ে দিয়েছে, গোটা আফগানিস্তান দখল করেও মাথা নোয়ানো যায় না পঞ্জশিরের।
সাবেক সোভিয়েত সেনা পারেনি। আমেরিকার সেনাবাহিনীও পারেনি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পারেনি তালিবানও।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় পঞ্জশির উপত্যকা বরাবরই দুর্ভেদ্য দুর্গ থেকে গিয়েছে বিদেশি হানাদারদের কাছে। প্রবল পরাক্রমী, নৃশংস তালিবানের কাছেও।
পঞ্জশিরের প্রধান রক্ষাকবচ হয়েছে প্রকৃতি। অত্যন্ত দুর্গম, সুউচ্চ হিন্দুকুশ পর্বতমালার প্রায় হাড়জমানো ঠান্ডায় পঞ্জশির উপত্যকাকে দখল করার স্বপ্ন অধরা থেকে গিয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর। তালিবদেরও।
হিন্দুকুশের কোলে আকারে ছোট হলেও খুব সাজানো এই উপত্যকার দ্বিতীয় রক্ষাকবচ সেখানকার তাজিক জনগোষ্ঠীর লক্ষাধিক মানুষ। আফগানিস্তানে তাজিক জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম বসতি পঞ্জশিরেই।
এই তাজিক জনগোষ্ঠীর মানুষ বংশানুক্রমেই যে কোনও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন বার বার। গত শতাব্দীর আটের দশক থেকে এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত।
এ বারও আফগানিস্তানের উত্তর প্রান্ত থেকে একের পর এক প্রদেশ কার্যত বিনা বাধায় পেরিয়ে দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছে কাবুলে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের ফটকের সামনে হাজির হয়ে গিয়েছিল তালিব সেনারা। তার পরেই সপরিবারে কাবুল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন গদি খোয়ানো প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি।
কিন্তু তাঁরই সরকারের উপরাষ্ট্রপতি, পঞ্জশির উপত্যকার সন্তান আমরুল্লা সালেহের মাথা এখনও পর্যন্ত নোয়াতে পারেনি তালিবরা। টুইট করে সালেহ্ জানিয়েছেন, তিনি এখনও আফগানিস্তানেই আছেন। আর শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইও চালিয়ে যাবেন। তালিবদের পরোয়া না করেই সালেহ্ জানিয়েছেন, আশরফ গনির অনুপস্থিতিতে তিনিই এখন আফগানিস্তানের তদারকি প্রেসিডেন্ট।
সালেহের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, পঞ্জশিরেই এখন রয়েছেন তিনি। যেখানে ঢোকার সাহসে কুলোয়নি প্রবল পরাক্রমী, নৃশংস তালিব যোদ্ধাদেরও।
কেন সাহসে কুলোয়নি তালিব যোদ্ধাদের?
যাঁরা আফগানিস্তানকে হাতের তালুর মতো চেনেন, জানেন সেই বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বিদেশি হানাদারই হোক বা তালিবান—দেশের যে কোনও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বংশানুক্রমে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে যে ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-এর, তার ভরকেন্দ্র এই পঞ্জশিরই। যা ‘সেকেন্ড রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘পঞ্জশির রেজিস্ট্যান্স’ নামেও সুপরিচিত। আফগানিস্তানে গত ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা এই প্রতিরোধ শক্তির অন্যতম নেতাদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি উজ্জ্বল নাম। আহমেদ শাহ মাসুদ, আমরুল্লা সালেহ্ এবং বিসমিল্লা খান মোহাম্মদি। গত শতাব্দীর আটের দশকে সাবেক সোভিয়েত সেনাদেরও রুখে দিয়েছিলেন পঞ্জশিরের তাজিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত যখন গোটা আফগানিস্তানে দাপিয়ে বেড়িয়েছে তালিবান, তখন তাদের বিরুদ্ধে মনে রাখার মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল প়ঞ্জশিরই। সেই সময় তালিবদের ঠেকাতে পঞ্জশিরের তাজিকরা দেশের উত্তর প্রান্তের অন্য জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলে ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’। সেই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন আহমেদ শাহ মাসুদ, আমরুল্লা সালেহ্, বিসমিল্লা খান মোহাম্মদি, করিম খলিলি, আবদুল রশিদ রস্তুম, আবদুল্লা আবদুল্লা, আবদুল কাদির, আসিফ মোহ্সেনি এবং মোহাম্মদ মোহাকিকের মতো লড়াকুরা। সেটা এক দিনে হয়নি। বিদেশি হানাদার ও তালিবদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য গত ৪ দশক ধরে অস্ত্র মজুত করে গিয়েছেন তাজিকরা।
পঞ্জশিরের নামকরণেই রয়েছে সেই লড়াইয়ের ইতিহাস। ‘পঞ্জশির’ কথাটির অর্থ পাঁচটি সিংহ। সেটা দশম শতাব্দীর কথা। সেই সময়ের আফগানিস্তান ছিল গজনির শাসক সুলতান মেহমুদের অধীনে। ভয়াল পাহাড়ি বন্যায় তখন ভেসে যেত গোটা পঞ্জশির উপত্যকা। তখন উপত্যকার পাঁচ ভাই মিলে গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল বাঁধ। যা পঞ্জশিরকে পরে ভয়াল বন্যার আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়েছিল। পাঁচ ভাইয়ের সেই সিংহবিক্রমকে স্মরণে রাখতেই পরে উপত্যকার নাম হয় পঞ্জশির।
সেই নামকরণের সার্থকতা এই সে দিন আরও এক বার প্রমাণিত হল গদি খোয়ানো প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির উপরাষ্ট্রপতি আমরুল্লা সালেহ্ তালিবদের পরোয়া না করার বার্তায়। তাঁর টুইটে সালেহ্ লিখেছেন, ‘হিংসা নয়, আইনের শাসনই থাকবে আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানের আকার, আয়তন এতটাই বড় যে পাকিস্তানের পক্ষে তা গিলে খাওয়া সম্ভব নয়। আর তালিবরাও পারবে না এত বড় দেশকে শাসন করতে।’ বৃহস্পতিবার রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রীও বলেছেন, “খবর পাচ্ছি, সালেহ্ ও আহমেদ মাসুদের নেতৃত্বে পঞ্জশিরে তালিবদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে।'