গড়ে উঠছে প্রতিরোধ ছবি: রয়টার্স।
প্রায় ন’হাজার সেনা নিয়ে তৈরি নর্দার্ন অ্যালায়ান্স। তালিবানের সামনে কিছুতেই মাথা নোয়াবে না পঞ্জশির।
গত কাল মনে হয়েছিল, পঞ্জশির-পতন অনির্বায। নর্দার্ন অ্যালায়ান্স নেতা আহমেদ মাসুদ তালিবান নেতাদের সঙ্গে অস্ত্র সংবরণের কথাবার্তা চালাচ্ছেন, এই মর্মে খবরও প্রকাশিত হয়েছিল এলাকার এক সংবাদপত্রে। কিন্তু আজ মাসুদ ফরাসি দার্শনিক বের্নার-অঁরি লেভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমি আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে। আত্মসমর্পণ শব্দটা আমার জানা নেই।’’ মাসুদের দাবি, ‘‘গত কয়েক দিনে হাজার হাজার ছেলে আমাদের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।’’ একটি প্রথম সারির ফরাসি দৈনিকে প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে মাসুদ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ-সহ তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, তাঁরা যেন নর্দার্ন অ্যালায়ান্সকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করেন। কারও নাম না করে মাসুদ বলেছেন, ‘‘আট দিন আগেও আমি বিদেশি শক্তির কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রত্যাখান করা হয়েছিল। আজ নিশ্চয় তাঁরা বুঝতে পারছেন, সেই সিদ্ধান্ত এক ঐতিহাসিক ভুল ছিল।’’
নর্দার্ন অ্যালায়ান্সের অন্তর্গত ‘পপুলার রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-এর কমান্ডার আমির আকমলও আজ এক টিভি সাক্ষাৎকারে জানান, আত্মসমর্পণের কোনও প্রশ্নই উঠছে না। তালিবান যে কোনও দিক থেকে পঞ্জশিরে প্রবেশের চেষ্টা করলেই বাধা দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত তাঁদের বাহিনী। আকমলের কথায়, ‘‘পপুলার রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্টে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা বেশির ভাগই কমবয়সি ছেলে। তাঁরা কখনওই তালিবানের দাসত্ব মেনে নেবেন না। তালিবান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সব সামরিক প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে, সে তারা যে দিক দিয়েই পঞ্জশিরে প্রবেশ করার চেষ্টা করুক না কেন। তালিবান যুদ্ধ করতেই আসুক, বা শান্তি প্রস্তাব নিয়ে, আমরা তাদের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি রয়েছি।’’
হিন্দুকুশ পর্বতমালায় ঘেরা পঞ্জশির উপত্যকার তাজিক জনগোষ্ঠী চিরকাল বহিরাগত শক্তিকে প্রতিহত করে এসেছে। আহমেদ মাসুদের বাবা আহমেদ শাহ মাসুদের সোভিয়েত বাহিনীর (১৯৮০-র দশকে) এবং তালিবানের (১৯৯৬-২০০১) সঙ্গে যুদ্ধের কাহিনী সেখানকার ঘরে ঘরে এখনও প্রচলিত। পাকিস্তানের মদতে ফের মাথাচাড়া দেওয়া তালিবান এখনও এই তাজিকদের ঘোর অপছন্দের। নিজেদের ক্ষমতার শেষ বিন্দু পর্যন্ত তালিবানের বিরুদ্ধে যে লড়াই করে যাবে তারা, আজ প্রতিরোধ-বাহিনীর বিভিন্ন নেতার কথায় স্পষ্ট।
গত কয়েক দিনে নর্দার্ন অ্যালায়ান্সের হাত আরও শক্ত করেছে আশরফ গনির সেনাবাহিনীর কয়েক শো সেনা। জানা গিয়েছে, তালিবান কাবুল দখল নেওয়ার পরেই পঞ্জশিরে চলে আসেন অসংখ্য সেনা। তাঁরাও নর্দার্ন অ্যালায়ান্সের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তালিবানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। এমনই এক সেনা হামিদের কথায়, ‘‘আফগান সেনাবাহিনীতে যখন ছিলাম, দেশকে তালিবানের হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি। তালিবান দেশের প্রায় পুরোটাই দখল করে ফেলেছে। কিন্তু এখন পঞ্জশিরে এসে দেখছি, মাতৃভূমিকে রক্ষা করার আর একটি সুযোগ এসেছে। পপুলার রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্টের লড়াইয়ে তাই যোগ দিয়েছি আমরা।’’
নর্দার্ন অ্যালায়ান্সে যোগ দিয়েছেন গনি জমানার ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালে-ও। আজ একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সালে বলেন, ‘‘তালিবান কাল দাবি করেছিল, পঞ্জশিরের একটা অংশ তাদের দখলে চলে এসেছে। এই দাবি সর্বৈব মিথ্যা। পুরো এলাকাটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমাদের সেনাদের মনোবল যথেষ্ট বেশি। তালিবানের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিতে রাজি নয় আমাদের ছেলেরা।’’ একই সঙ্গে সালে বলেছেন, ‘‘আমরা শান্তি-আলোচনার পক্ষপাতী। কিন্তু সেই আলোচনা যদি ফলপ্রসূ না হয়, তা হলে সর্বশক্তি দিয়ে তালিবানকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত রয়েছি।’’
সালের পাল্টা দাবি করেছেন তালিবান কমান্ডার মোল্লা খকসর। আজ তিনি বলেন, ‘‘যে কোন দিন পঞ্জশিরে আমরা ঢুকে পড়তে পারি। শুধু মোল্লা হেবাতুল্লার (তালিবানের অন্যতম শীর্ষ নেতা) নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি।’’
নর্দার্ন অ্যালায়ান্সের প্রয়াত নেতা মাসুদের ভাই, তথা বর্তমান নেতা আহমেদ মাসুদের কাকা আহমেদ ওয়ালি মাসুদের মতে, ‘‘আমাদের এখনও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রয়েছে। তালিবান যতই বলুক, সব কিছু ঠিক রয়েছে, সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন কাজকর্মে যোগ দিতে পারেন, পরিস্থিতি আদপেই সে রকম নয়। দেশজুড়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থা চলছে। কাবুল-সহ দেশের বিভিন্ন শহর থেকে পিলপিল করে লোকজন পালাচ্ছে। আমাদের প্রতিরোধ-বাহিনী তো এক দিনে তৈরি হয়নি। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানে, তালিবান-রাজ কী ভাবে ঠেকাতে হবে।’’ ২০২১-এর তালিবান যে ২০০১-র তালিবান থেকে আদপেই আলাদা নয়, সে বিষয়েও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘‘বারবার তালিবান বলছে যে, এ বার তারা অনেকটাই আলাদা। এখনও পর্যন্ত তার কোনও পরিচয় পাইনি।’’