গ্রাউন্ড জ়িরোর কাছেই ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। রয়টার্স
আর পাঁচটা শনিবারের মতো আজও হয়তো কেউ পার্টি করবেন, সিনেমা দেখবেন, কিংবা সময় কাটাবেন সমুদ্রসৈকতে। গতানুগতিক ছন্দে চলবে সপ্তাহান্তের আমেরিকা।
কিন্তু ২০ বছর আগে আজকের দিনেই ভয়ঙ্কর আক্রমণের মুখে পড়েছিল এই দেশ। অন্য দিনের মতোই সে দিনও এনজে ট্রানজ়িটে (ট্রেন) চেপে কর্মস্থলে যাচ্ছিলাম, কে জানত দিনটা কোনও ভাবেই আর গতানুগতিক থাকবে না!
সে রাতে আমি বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার অনেক সহযাত্রীই বাড়ি ফেরেননি। প্রায় তিন হাজার মানুষ ওই ভয়ঙ্কর হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। না চাইতেও ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায়ের অংশ হয়ে রয়ে গেলাম। এক লহমায় বদলে গেল চেনা পৃথিবীটা।
সে দিন আততায়ীরা যখন হামলা চালায় আমি তখন ট্রেনে। জানলা দিয়ে তাকালেই এই বিভীষিকাময় দৃশ্য চোখে পড়ত। কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পেন স্টেশন থেকে সাবওয়ে ধরতে গিয়ে দেখি দু’-দু’টো ট্রেন বাতিল। তার পর অবশ্য একটি ট্রেন পেলাম। তখনও জঙ্গি হামলার বিষয়ে কিছুই জানি না। সাবওয়ে থেকে নেমেই দেখি আমার অফিস ম্যাকগ্র হিল বিল্ডিংয়ের চারপাশে জনসমুদ্র। ভিড় ঠেলে এগোতেই খুঁজে পেলাম বসকে। বোকার মতোই জিজ্ঞেস করালাম,
গোটা অফিসের লোকজন কাজ ছেড়ে বাইরে ভিড় করেছে কেন? ও হতবাক হয়ে বলল, ‘‘তুমি কি কিছুই জানো না! জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে। এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাও।’’ কিন্তু যাব কী ভাবে! তত ক্ষণে সাবওয়ে, বাস... সব বন্ধ।
সারা দিন আটকে ছিলাম ম্যানহাটনের মিডটাউনে। সব টানেল, ব্রিজ বন্ধ। বাড়ি ফেরার পথই যে শুধু বন্ধ তা-ই নয়, ফোনের কানেকশনও স্তব্ধ। তাই বাড়িতেও যোগাযোগ করা যায়নি। ম্যানহাটনের ওই দ্বীপ কার্যত গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন সেই সময়ে। এ দিকে নানা গুজব উড়ছে চারদিকে। শুনছি জঙ্গিদের পরের নিশানা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে লোকজন। কাঁদছে, চিৎকার করছে। গ্রাস করেছে অজানা ভয়। চারদিকে দমবন্ধ করা ধোঁয়ার গন্ধ। মনে হচ্ছে, এ কি মৃত্যুর গন্ধ!
মনে হচ্ছিল, এক বার যদি ছ’মাসের মেয়েটার তুলতুলে শরীরটা আঁকড়ে ধরতে পারতাম। আমার স্বামীর গমগমে গলাটা কানে বাজছিল। ভেসে উঠছিল মায়ের মুখ। এদের কি আর কাছে পাব? এক পা, এক পা করে হেঁটে ভীত, সন্ত্রস্ত জনসমুদ্র ঠেলে, অবশেষে ফেরিঘাটে পৌঁছলাম। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বোটে চেপে নিউ জার্সির ভিহাকেন-এ পৌঁছলাম। সেখান থেকে রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বাড়ি ফিরলাম।
ঘটনাটা এতই নাড়া দিয়েছিল যে, প্রায় ১০ বছর এই নিয়ে কোনও আলোচনা করতাম না। ৯/১১ নিয়ে কোনও ছবি বা তথ্যচিত্রও দেখতে পারতাম না। এখনও সে দিনের কথা মনে পড়লে চোখে জল চলে আসে।
সে দিন প্রেসিডেন্ট বুশের কথা সারা পৃথিবীকে আশ্বাস দিয়েছিল। আজ ২০ বছর পরে আমাদের জীবনের ছন্দ যে নিশ্চিন্ত ভাবে চলছে, তার জন্য দেশের সাহসী নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, কোথায় হারিয়ে গেল সেই স্লোগান ‘আমরা ভুলব না’। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাহারি শাড়ির আঁচলে ঢাকা পড়ে গেল, না কি কোনও জন্মদিন উদ্যাপনের হইচইয়ে মিলিয়ে গেল? না কি এটাই স্বাভাবিক? বীভৎস স্মৃতি মুছে গিয়ে সবাই এক নিরাপদ গতানুগতিক ধারায় জীবন কাটাচ্ছে, কাটাতে পারছে। হয়তো এটাই কাম্য। কারণ, ৯/১১-র গল্প তো শুধু মর্মান্তিক স্মৃতি নয়, এ গল্প দেশাত্মবোধ, সাহসেরও। ‘গড ব্লেস আমেরিকা’। আমরা ভুলব না।